মামলায় বিপাকে বিএনপি

প্রকাশিত: ১৭ জানুয়ারি ২০১৯, ০৮:৪১ এএম

কামরুল হাসান: অসংখ্য মামলায় অভিযুক্ত ও কারাগারে আটক নেতাকর্মীদের মুক্তি নিয়ে বিপাকে রয়েছে বিএনপি। কেন্দ্র থেকে এসব মামলা পরিচালনার জন্য জেলা বিএনপিকে নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এলাকায় তাদের কার্যকর কোনো ভূমিকা নেই বলে অভিযোগ তৃণমূল নেতাকর্মীদের। এসব ক্ষেত্রে আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য কেন্দ্র থেকে গঠিত জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম ও জাতীয় আইনি সহায়তা কেন্দ্রেরও কোনো হদিস নেই বলে জানিয়েছেন তারা।

তবে দলটির নীতিনির্ধারক নেতৃবৃন্দ জানান, নির্বাচনের পর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন তারা। নির্বাচনকেন্দ্রিক নির্যাতিত তৃণমূল নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়ে দলকে চাঙ্গা করার চেষ্টাও করছেন। মামলা-হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীদের মামলা পরিচালনা, চিকিৎসার ব্যবস্থা করছেন তারা। এরই মধ্যে আইনজীবীদের নিয়ে আইনি সহায়তা সেল গঠনের পাশাপাশি জেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দকে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন। এর জন্য জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে। এরই অংশ হিসেবে গত সোমবার ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা সিলেট যান। সেখানে নির্বাচনের দিন নিহত বালাগঞ্জ উপজেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সায়েম আহম্মেদ সোহেলের কবর জিয়ারতসহ তার পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা জানান তারা। এর আগে তারা নোয়াখালীর সুবর্ণচরে নির্যাতিত নারীকেও দেখতে গিয়েছিলেন। তাদের এই কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এসব মামলার উদ্দেশ্য এখন স্পষ্ট। একতরফা নির্বাচনের জন্য তারা এসব করেছিলেন। নির্বাচনের আগে ও পরে তাদের হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে আটক হয়েছেন। এখনও গ্রেফতার চলছে। আবার যারা উচ্চ আদালতের জামিন শেষে নিম্ন আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন, তাদেরও কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এভাবে সরকার পুরো দেশটাকে একটা কারাগারে পরিণত করেছে।

স্থায়ী কমিটির এক সদস্য জানান, কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে একেবারে ওয়ার্ড পর্যায়ে পর্যন্ত মামলার পাহাড় জমেছে। শুধু জামিন নিতেই সর্বস্বান্ত হতে হচ্ছে নেতাকর্মীদের। পরিস্থিতি এখন তাদের সামর্থ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আয়োজিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সংলাপের পরিপ্রেক্ষিতে দুই দফায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সারাদেশে গায়েবি মামলার নথি দেওয়া হলেও কোনো সুফল আসেনি।

দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, গত ৮ নভেম্বর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চার হাজার ৪৭০টি মামলা হয়েছে। এতে এজাহারনামীয় আসামির সংখ্যা ১৬ হাজার ৮৩০ জন এবং অজ্ঞাতপরিচয় আসামির সংখ্যা ৯৫ হাজার ৭৩৩ জন। এসব মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে ১৫ হাজার ৮৯৮ জনকে। নির্বাচনকালীন ও পরে হামলার ঘটনা রয়েছে চার হাজার ১১৬টি। এসব হামলায় আহত হয়েছেন ১৭ হাজার ১৩ জন এবং নিহত হয়েছেন ১৭ নেতাকর্মী।

এ ছাড়া গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে চার হাজার ৪৫৩টি। এসব মামলায় এজাহারনামীয় আসামি এক লাখ ১১ হাজার ৭৫ জন, অজ্ঞাতপরিচয় আসামি তিন লাখ ২৭ হাজার ৭৫৭ জন। এ সময়ের মধ্যে গ্রেফতারের সংখ্য ১১ হাজার ৫৮ জন।

দলের দপ্তর থেকে দাবি করা হয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত মোট মামলার সংখ্যা ৯০ হাজার ৩৪০টি। আসামির সংখ্য ২৫ লাখ ৭০ হাজার ৫৪৭ জন। মোট হত্যার সংখ্যা এক হাজার ৫১২ জন। গুরুতর আহাত ও জখম হয়েছেন ১০ হাজার ১২৬ জন।

দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, এসব তথ্য সারাদেশে নির্যাতনের একটি খণ্ডচিত্র। কারণ অনেক মামলা ও হামলার খবর কেন্দ্র পর্যন্ত আসে না বলে সেসব বিষয়ে তারা জানতেও পারছেন না। যেসব নেতাকর্মী তাদের নামে মামলার কাগজ দিচ্ছেন, কারাগারে যাচ্ছেন, হামলায় আহত হচ্ছেন, তাদের বিষয়ে কেন্দ্র জানতে পারছে।

দলের নেতাকর্মীরা জানান, মামলা পরিচালনায় জেলা ও আসনভিত্তিক অনেক নেতা সচেষ্ট। উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন নেওয়ার প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে নিম্ন আদালতের মামলাও তারা পরিচালনা করছেন। দলের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান সমকালকে বলেন, গত রোববারও নোয়াখালী জেলার ২৫৮ নেতাকর্মী উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। বুধবার আরও সাড়ে তিনশ’ নেতাকর্মী ঢাকা আসবেন জামিনের জন্য। নির্বাচনী সহিংসতার ক্ষয়ক্ষতি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। চাঁদপুর জেলা বিএনপির সভাপতি শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক বলেন, উচ্চ আদালত থেকে প্রায় দেড় হাজার নেতাকর্মীর জামিন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে হয়েছে। এ সংখ্যা আরও বাড়বে।

বিএনপি নেতারা অভিযোগ করছেন, দেশের বেশিরভাগ আসনেই ভিন্ন চিত্র বিরাজ করছে। যেসব আসনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের নেতাদের প্রার্থী করা হয়েছিল, সেসব এলাকার নেতাকর্মীদের অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে। এসব নেতার অনেকেই নির্বাচনের পর এলাকা ছেড়েছেন। সাধারণ কর্মীদের সঙ্গে তাদের কোনো সংযোগ আর নেই বললেই চলে। আবার বেশ কিছু আসনে ‘হঠাৎ নেতা’দের মনোনয়ন দেওয়ায় তারাও নির্বাচনের পর এলাকা ছেড়েছেন। এখন মোবাইল ফোন বন্ধ করে রেখেছেন। এসব এলাকার নেতাকর্মীরা প্রতিদিনই কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। ঢাকা-১৮ আসনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ধানের শীষে প্রার্থী থাকলেও এ এলাকার নেতাকর্মীদের মামলা পরিচালনা ও কারাগারে আটক কর্মীদের জামিনের জন্য বিএনপি নেতাদের কাছেই ছুটতে হচ্ছে তাদের।

ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর জানান, তাদের সাত থানায় ১০৪টি গায়েবি মামলায় প্রায় সাড়ে সাত হাজার নেতাকর্মী আসামি হয়েছেন। কারাগারে রয়েছেন প্রায় দুইশ’ নেতাকর্মী। এসব মামলা ও কারাগারে আটক নেতাকর্মীদের আইনি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

দলীয় সূত্র জানায়, দলের নেতাকর্মীদের মামলা পরিচালনার জন্য কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠন করা হলেও বাস্তবের সঙ্গে এসব কমিটির কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাননি নেতাকর্মীরা। তারা জানান, জেলা বিএনপির নেতারা মামলা পরিচালনায় কিছুটা সাহায্য করলেও আইনি সহায়তা কেন্দ্রের কোনো কার্যক্রম সম্পর্কে তারা জানেন না। নিজ উদ্যোগে কিংবা পারিবারিকভাবে অথবা জেলা বিএনপির পছন্দমতো আইনজীবীর সহায়তা নিচ্ছেন তারা।

এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের এক আইনজীবী জানান, নির্বাচনের এক মাস আগে একটি জাতীয় আইনি সেল গঠন করা হয়েছিল। এই সেলে পাঁচজনের একটি কমিটি গঠন করা হলেও তা আর পূর্ণাঙ্গ হয়নি। দলের কেন্দ্র থেকে এ বিষয়ে কোনো সহায়তা কিংবা নির্দেশনাও ছিল না। এর বাইরে ১৮ বছরের মেয়াদোত্তীর্ণ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম নামে একটি সংগঠন কাগজে কলমে থাকলেও এর কোনো কার্যক্রম নেই।

তিনি বলেন, তিন নেতার এ ফোরাম কোনো কাজে আসেনি। এ কারণে তৃণমূল নেতাকর্মীরাও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে এ সংগঠনকে পুনর্গঠন করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। দলের হাইকমান্ডও বেশ কয়েকবার আইনজীবীদের সঙ্গে বৈঠক করে এই সংগঠনকে পুনর্গঠনের নির্দেশনা দেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের সংগঠন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি হিসেবে স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ও যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া দায়িত্ব পালন করছেন। তবে এসব কমিটির বাইরেও অনেক আইনজীবী নিজ উদ্যোগে দলের নেতাকর্মীদের আইনি সহায়তা দিচ্ছেন এবং মামলা পরিচালনা করছেন বলে জানান বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সজল। সূত্র: সমকাল।

বিডি২৪লাইভ/টিএএফ

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: