বাংলাদেশে মেডিকেল উচ্চশিক্ষা ও কিছু ভাবনা

প্রকাশিত: ১৯ জানুয়ারি ২০১৯, ০৭:৩৮ পিএম

দেশের সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় ইদানিং একটা আমুল পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। স্কুল কলেজ গুলোতে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠদান হচ্ছে এবং সেই অনুযায়ী পরীক্ষাও হচ্ছে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বিসিপিএস থেকে এফসিপিএস পাশ করা ডাক্তাররাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছেন এবং শিক্ষকতার কাজে নিয়োজিত আছেন। এমনকি বিদেশেও এফসিপিএস পাশ করা ডাক্তারগণও সুনামের সহিত কাজ করে যাচ্ছেন। এফসিপিএস এখন একটি আস্থার নাম। বিসিপিএস এর শিক্ষাদান পদ্ধতি অনেকটা ব্রিটিশ রয়েল কলেজের ধাঁচে পরিচালিত।

এমবিবিএস পাশ করার পরে ডাক্তাররা তাদের চাকুরীকালীন অবস্থাতেই নিজ-নিজ পছন্দমত বিষয়ের উপর মেডিকেল কলেজ বা বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান বা জেলা সদর হাসপাতালে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ নেয়। সেসব প্রতিষ্ঠানগুলো অবশ্য বিসিপিএস কর্তৃক নির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হতে হয়। বিসিপিএস সেই সকল প্রশিক্ষণার্থী এবং প্রশিক্ষক সবাইকে তার নিজস্ব নিয়ম অনুযায়ী মনিটর করে থাকে। বিষয় ভিত্তিক বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন মেয়াদের প্রশিক্ষণ শেষে ফাইনাল পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। দেশী-বিদেশী পরীক্ষকের সমন্বয়ে নেয়া বিভিন্ন স্তরের পরীক্ষা শেষে মানদণ্ডের কষ্টি পাথরে যাচাইয়ের পর তারা পরীক্ষায় পাশ করলে এফসিপিএস ডিগ্রী লাভ করে।

স্বাধীনতার আগে থেকেই শাহবাগস্থ ইনস্টিটিউট অব পোষ্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিসিন এন্ড রিসার্চ তথা আইপিজিএমআর দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা দিয়ে আসছিল। এফসিপিএস পরীক্ষা দেওয়ার আগে এখানেই বেশীরভাগ ডাক্তাররা তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিত। দেশের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালে আইপিজিএমআরকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তরিত করা হয় এবং সেখান থেকে বিভিন্ন বিষয়ে MD, MS, M phil, Diploma ইত্যাদি স্নাতকোত্তর ডিগ্রী প্রদান শুরু হয়। সাথে অধিভূক্ত কিছু কিছু মেডিকেল কলেজ ও বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গুলোতেও অনেক বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স চালু করা হয়।

অর্থাৎ এখন বর্তমানে দুইটি প্রতিষ্ঠান স্নাতকোত্তর চিকিৎসা শিক্ষার সাথে জড়িত। একটি বিসিপিএস এবং অন্যটি বিএসএমএমইউ। চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে আরও ২টি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় তাদের কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে। এবং অচিরেই আরও কয়েকটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় চালু হবে। এতে নিঃসন্দেহে দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়বে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো এখন যেভাবে চলছে তাতে মানসম্মত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরী হবে কিনা?

এখানে বলে রাখা ভাল বিশ্ববিদ্যালয় বা তার অধিভুক্ত মেডিকেল কলেজগুলো থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী পেতে হলে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ভর্তি হওয়ার পর ক্লিনিক্যাল বিষয় গুলোতে ৫ বছরের জন্য ডেপুটেশনে আসতে হয়।

ফলে অনেক সময় অনেক জায়গায় ডাক্তার থাকেনা, তার একটা কারণ কিন্তু এই ডেপুটেশন প্রথা।

অন্যদিকে বিসিপিএস থেকে এফসিপিএস করতে কোথাও ভর্তি হতে লাগেনা। ডাক্তাররা স্ব-স্ব কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে করতে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের পরে ফিস জমা দিয়ে চুড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে। সেখানে কোন ডেপুটেশন না হলেও চলে। এই প্রশিক্ষণের জন্য শিক্ষার্থীকে কোন টাকা-পয়সা খরচ করতে হয় না এবং শিক্ষকরাও তাদের প্রচলিত বেতনের বাইরে আর কোন বিশেষ আর্থিক সুবিধা পান না। দুইটি প্রতিষ্ঠান থেকেইে একই বিষয়ের উপর ডিগ্রী দেয়া হচ্ছে, যদিও তাদের মধ্যে মানের তারতম্য আছে।

তাই সময় এসেছে দেশে মানসম্মত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরীর লক্ষ্যে একটি সমন্বিত স্নাতকোত্তর চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। আমরা যদি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারি, তাহলে রোগীরা আস্থাহীনতায় ভুগবে এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাতে শুরু করবে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বিএমডিসি ও বিএমএ সমন্বিত উদ্যোগ নিলে একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করা যেতে পারে। এমন হতে পারে বিসিপিএস মুলত জেনারেল বিষয়গুলোতে এফসিপিএস ডিগ্রী দেবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় গুলো স্পেশালিটি বিষয় সমুহে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী যেমন এম.ডি, এম.এস ইত্যাদি ডিগ্রী দেবে। অধুনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উক্তিটিও প্রণিধান যোগ্য।

তিনি বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় হবে গবেষণার জায়গা। সাধারণ বিষয়ে শিক্ষাদান করা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হবে না। তাই যদি হয় তাহলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরীর পূর্বে Parent Subject এ Core Training করতে হয় সেটার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় উপযুক্ত স্থান নয়।

কোন বিষয়ে ভাল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হতে হলে তার সংশ্লিষ্ট জেনারেল সাবজেক্ট সম্বন্ধে ভাল জ্ঞান ও দক্ষতা থাকতে হয়। উন্নত বিশ্বের সব দেশেই একই নিয়ম। যেমন একজন ভাল কার্ডিওলজিস্ট হতে হলে তাকে মেডিসিন ভাল জানতে হবে। যেহেতু আমাদের দেশে বেসিক ডিগ্রী তথা এমবিবিএস ডিগ্রীর মান কমে গেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ছেড়ে দেওয়া উচিত গবেষণা কাজে মনোনিবেশ করার জন্য।

তাই বিশেষজ্ঞ তৈরীর প্রথমিক ধাপ হিসেবে তার Parent Subject এ Core Training জন্য অন্য কাউকে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। আর এই কাজটা বিসিপিএস ভালভাবেই করে আসছে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

তিন পর্যায়ে বাংলাদেশের স্নাতকোত্তর চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থা করতে পারলে ভাল হয়। প্রথম ধাপে এমবিবিএস পাশ করার পর ইন্টার্নশীপ শেষ করবে। ২য় ধাপে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিয়ে জেনারেল বিষয়ে এফসিপিএস পাশ করবে। ৩য় ধাপে তাদের মধ্য থেকে যারা চাইবে তারা বিশ্ববিদ্যালয় গুলো থেকে স্পেশালিটি বিষয়গুলোতে নির্ধারিত প্রশিক্ষণ নিয়ে MD,MS ইত্যাদি স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করে বিশেষজ্ঞ হবে। তাদের থেকে কেউ আবার বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে অধিকতর গবেষণা কাজে নিয়োজিত থেকে PHD করতে পারবে।

এতে করে দেশে যে উন্নত মানের বিশেষজ্ঞ তৈরির রাস্তা প্রসারিত হবে তা বোধকরি সবাই স্বীকার করবেন। এতে উচ্চশিক্ষা সংকুচিত হয়ে যাবে, দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা কমে যাবে বলে অনেকে মনে করতে পারেন।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্র পাওয়ার জন্য বিসিপিএস এর মুখাপেক্ষী থাকতে হবে বলে অনেকে ধারনা করতে পারেন। যারা এফসিপিএস পাশ করার জন্য কষ্ট স্বীকার করতে রাজী না, যারা সহজে কোন একটা স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করার চেষ্টারত, তারাই এসব বলে বেড়াতে পারে। জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে, জনগণের সরকারই পারে এ ব্যাপারে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে।

প্রশ্ন হল আমরা কি Quality চাই; নাকি Quantity চাই? আমরা তো জানিনা দেশে কোন বিষয়ে কত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দরকার। সময় এসেছে এসব কিছু ভেবে দেশের স্নাতকোত্তর চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরণের ধ্বস নামার পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়, বিসিপিএস, বিএমডিসি, প্রফেশনাল বডি এবং চিকিৎসা শিক্ষার সাথে জাড়িত বিশেষজ্ঞগণ মিলে একটি আধুনিক যুগোপযোগী সমন্বিত স্নাতকোত্তর চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য এক যোগে কাজ করার।

কথা উঠতে পারে সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যদি শুধু MD, MS দেয়া হয়, মেডিকেল কলেজ ও বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গুলো কি করবে? উত্তর হলো মেডিকেল কলেজ গুলো উন্নত মানের এমবিবিএস ডাক্তার তৈরি করবে, আর এফসিপিএস পরীক্ষা দেয়ার পূর্বে যে প্রশিক্ষণ লাগবে সেই প্রশিক্ষণ তারা দিবে। বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সেবার কাজে নিয়োজিত থাকবে এবং বিভিন্ন বিষয়ে উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজটি করবে। যার যে কাজ তার সে কাজটাই ভালভাবে করা উচিত।

লেখক: অধ্যাপক মোঃ আব্দুল জলিল চেীধুরী
অধ্যাপক (মেডিসিন বিভাগ), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও
অনারারি সচিব, বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস্ এন্ড সার্জনস্ (বিসিপিএস)।

খোলা কলামে প্রকাশিত লেখার সাথে প্রতিষ্ঠানের কোন সম্পর্ক নেই। এটা লেখকের একান্ত মতামত।

বিডি২৪লাইভ/এইচকে/আরএইচ

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: