পরকীয়া প্রেম, স্বামী হত্যা: অতঃপর সেই স্নিগ্ধার ফাঁসি

প্রকাশিত: ২৯ জানুয়ারি ২০১৯, ০১:৫০ পিএম

আইনজীবী স্বামীর সাথে তার কলহ লেগেই থাকতো। একে অপরের মধ্যে অবিশ্বাস, অশান্তি, সময় না দেয়া, হাত খরচের টাকা না দেয়াসহ অনেক অভিযোগ ছিল স্বামীর প্রতি স্ত্রীর। একাকিত্ব থেকেই সহকর্মীর প্রতি পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েন তিনি। এরপর পরকীয়া প্রেমিকের সাথে পরিকল্পনা করে স্বামীর খাবারে ঘুমের ট্যাবলেট মিশিয়ে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা।

বলছিলাম রংপুরে আইনজীবী রথিশ চন্দ্র ভৌমিক বাবু সোনা হত্যাকাণ্ডের মূল ঘটনা। চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল রথিশ চন্দ্রের স্ত্রী দীপা ভৌমিকের প্রেমিক কামরুল ইসলাম। তার পরিকল্পনাতেই ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ রাত সাড়ে দশটার দিকে হাত-পা বেঁধে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করা হয় আইনজীবী রথিশকে।

রংপুরে বহুল আলোচিত আইনজীবী রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবুসোনার হত্যা মামলায়র রায়ে স্ত্রী স্নিগ্ধা ভৌমিক দীপাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুর নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

সরকারী কৌশুলী (পিপি) এবং রাষ্ট্র নিযুক্ত আসামী পক্ষের আইনজীবি‘র মধ্যে যুক্তি তর্ক শেষ হওয়ার পর রংপুরের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিজ্ঞ বিচারক এ বি এম নিজামুল হক আজ মঙ্গলবার (২৯ জানুয়ারি) এ রায় ঘোষণা করেন।

ঘটনার সূত্রে জানা যায়, রংপুরের বিশেষ জজ আদালতের পিপি নিহত এড. রথীশ চন্দ্র ভৌমিক একাধিক নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় আসক্ত ছিলেন। এ নিয়ে স্ত্রীকে প্রায়ই সময় মারধর করতেন। স্নিগ্ধা রাণী দীপা ভৌমিক নিজের এ কষ্টের কথা বলতেন সহকর্মী কামরুল ইসলামের কাছে। কথা বলতে বলতে তারা একে অপরের প্রেমে আসক্ত হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে স্বামীর পরকীয়ার প্রতিশোধ নিতেই পরকীয়ায় জড়িয়ে যান দিপা।

এ ব্যাপারে আদালতে জবানবন্দিতে স্নিগ্ধা রাণী দীপা বলেন, একাধিক নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় আসক্ত ছিল রথীশ। আমাকে অবজ্ঞা-অসম্মান করত। শুধু তাই নয়, আমার বিবাহিত জীবন ছিল অশান্তিতে ভরা। ২৫ বছরের বিবাহিত জীবন কখনোই সুখের হয়নি। পরস্পরকে কেউ বিশ্বাস করতাম না। আমাকে অবিশ্বাস করায় আমিও স্বামীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারিনি। আমাকে প্রায় মারধর করত। এ ব্যাপারে বাড়িতে স্বজনদের নিয়ে সালিশ বৈঠকও হয়। এ কারণে আমাদের মধ্যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এসব কষ্টের কথা আমার সহকর্মী কামরুলকে জানাই। একপর্যায়ে তার প্রেমে জড়াই। পথের কাঁটা সরিয়ে দিতে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।

তিনি জানান, যেহেতু জেএমবির হামলায় নিহত জাপানি নাগরিক হোসি কুনিও ও মাজারের খাদেম রহমত আলী হত্যা মামলার সরকার পক্ষের প্রধান আইনজীবী ছিলেন রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবু সোনা। সে কারণে তাকে খুন করলে সবাই ভাববে জঙ্গিরাই তাকে মেরে ফেলেছে। এ ভাবনা থেকেই তাকে হত্যা করা হয়।

পরকীয়ায় আসক্ত স্নিগ্ধা ও কামরুল তাদের ২ ছাত্রকে লাশ গুমের জন্য মাটি খুঁড়ে গর্ত করা ও লাশ মাটিচাপা দেয়ার কাজে ব্যবহার করেছিল। এজন্য তাদের ৩০০ টাকা দিয়েছিল। তাদের উপবৃত্তির টাকা ও পরীক্ষার ফলাফল ভালো করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কামরুল। এ বিষয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিল ২ ছাত্র সবুজ ইসলাম (১৭) ও রোকনুজ্জামান (১৭)।

পুলিশের একটি সূত্র জানায়, আইনজীবী রথিশের সঙ্গে তার স্ত্রীর কলহ লেগেই থাকতো। এছাড়া একে অপরের মধ্যে অবিশ্বাস, অশান্তি, স্ত্রীকে সময় না দেয়া, স্ত্রীকে হাত খরচের টাকা না দেয়া এবং একাকিত্ব থেকেই সহকর্মী কামরুলের প্রতি পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েন স্নিগ্ধা।

পুলিশের সূত্রটি আরও জানিয়েছে, রথিশ এবং তাঁর স্ত্রীর মধ্যে এতটাই সম্পর্ক খারাপ ছিল যে দুজনে একই ঘরে থাকলেও তাদের মধ্যে খুব বেশি কথা হতো না। এছাড়া রথিশ চন্দ্র সংসার চালানোর খরচও দিতে চাইতো না। স্বামীর টাকা-পয়সা, সম্পত্তি, কোথায় কী আছে তারও কোনো খোঁজ পেত না স্ত্রী। এতে অতিষ্ঠ হয়ে সহকর্মী কামরুলের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করেন তিনি। সুযোগ কাজে লাগিয়ে কামরুল তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন।

পুলিশের সূত্রটি আরও জানায়, মূলত বছরখানেক আগেই কামরুলের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে সিগ্ধা। মাঝে মাঝে কামরুল প্রেমিকা স্নিগ্ধার বাসায় রাত কাটাতো। গত বছরের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে স্নিগ্ধা সরকার দীপাকে ধর্মান্তরিত হওয়ার এবং বিয়ের প্রস্তাব দেয় কামরুল। স্নিগ্ধা সেই প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে পরকীয়া চালিয়ে যান। আর তাদের পরকীয়ায় যেন পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে না পারেন সেজন্য এ মাস আগে রথিশ চন্দ্র ভৌমিককে হত্যার পরিকল্পনা করেন কামরুল ও স্নিগ্ধা।

এরপর ২০১৮ সালের ১০ নভেম্বর রথীশ চন্দ্র ভৌমিক হত্যা মামলার প্রধান আসামি কামরুল ইসলাম মাস্টার (৪৫) অসুস্থ হয়ে মারা যান। ওই দিন ভোরে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ভোর ৫টার দিকে তার মৃত্যু হয়। কামরুল ইসলাম বেশ কিছুদিন থেকে ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের সমস্যায় ভুগছিলেন। ভোর রাতে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর অবস্থা গুরুতর হলে তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে দায়িত্বরত চিকিৎসক ভোর ৫টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তবে ধারণা করা হচ্ছে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে বলে জানান কারা কতৃপক্ষ।

উল্লেখ্য, গত ২৯ মার্চ খাবারে ঘুমের ট্যাবলেট মিশিয়ে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আইনজীবী রথিশকে হত্যা করে কামরুল ও স্নিগ্ধা। পরদিন মোল্লাপাড়ার কামরুলের ভাইয়ের নির্মাণাধীন একটি বাড়িতে লাশ পুঁতে রাখা হয়।

তার নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে উত্তাল হয়ে উঠে রংপুর। এরপর তার সন্ধান পেতে সাঁড়াশি অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পাঁচ দিন নিখোঁজ থাকার পর গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে নগরীর তাজহাট মোল্লা পাড়ার একটি বাসা থেকে রথিশ চন্দ্রের গলিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। জঙ্গি-জামায়াত বা ব্যক্তিগত বিরোধসহ বিভিন্ন কারণে তিনি নিখোঁজ হতে পারেন এমন ধারণা করা হলেও পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানায় স্ত্রীর পরিকল্পনাতেই খুন হন আইনজীবী রথিশ।

খুনের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে এমন সন্দেহে রথিশ চন্দ্রের স্ত্রী দীপা ভৌমিক, মেয়ে অদিতি ভৌমিক, দীপা ভৌমিকের পরকীয়া প্রেমিক কামরুল ইসলাম এবং দুই স্কুলছাত্রকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রথিশ চন্দ্রের মেয়ে অনিতা ভৌমিককে ছেড়ে দেয় র্যাকব।

এছাড়া রথিশ চন্দ্র খুনের ঘটনায় তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক ও সহকারী মিলন মোহন্তকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়।

বিডি২৪লাইভ/এআইআর

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: