টাকা দিয়ে আমরা জীবানু খাচ্ছি!

প্রকাশিত: ২২ মার্চ ২০১৯, ০৩:৪৪ পিএম

মিজতাহা। তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। পড়ে মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজে। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ছয়টায় উঠে তাকে স্কুলের জন্য তৈরি হতে হয়। তার মা ইতি খানম তাকে সহোযোগিতা করেন। বাসায় সকালের নাস্তা তৈরি থাকলেও তেমন একটা খেতে চা য়না মিজতাহা। স্কুলে যাবার পথে বেশ কিছু মুখরোচক খাবার নজর কাড়ে তার।

সকাল নয়টায় স্কুল ছুটি হয় মিজতাহার। তখন তারা দাদা তাকে স্কুল থেকে আনতে যায়। আর সে দাদার কাছে করে বসে রাজ্যের আবদার।

মিজতাহা দাদার কাছে আবদার জানায় আচার খাওয়ার। কিন্তু আচারের নোংরা অবস্থা দেখে বাঁধ সাধে দাদা। পরে তাদের সামনে আসে ফুসকা। আর মিজতাহার জোরাজুরিতে শেষমেষ তাকে ফুসকা কিনে দেন দাদা। খেতে খেত কথা হয় মিজতাহার সাথে। সে জানান ফুচকা খাওয়ার পর আর কিছু খেতে ইচ্ছা করে না তার। শুধু মিজতাহা নয় এমনটা জানিয়েছে আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী।

কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কাছে এসব খাবার বিক্রি করে সংসার চলে অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের। যাদের বেশিরভাগেই মানতে চান না তাদের খাবার খেয়ে নানান সময় রোগে আক্রান্ত হয় কোমলমতি শিশু ও শিক্ষার্থীরা।

এ রকম দৃশ্য চোখে পড়ে রাজধানীর উত্তরার রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, ভিকারুন্নেসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বেইলি রোড শাখা, মনিপুর স্কুলসহ রাজধানীর বেশিরভাগ স্কুল এবং কলেজের সামনে।

এ বিষয়ে কথা হয় কয়েকজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সাথে। তাদেরই একজন রাজীব। তিনি কেন হাতে কোন ধরনের গ্লাভস পড়েন না এবং তার খাবার অস্বাস্থ্য কি না জানতে চাইলে তিনি জানান, বার বার পানি লাগার ফলে তার হাতের গ্লাভস নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া তার খাবার খেয়ে এখনও কারও কোন সমস্যা হয়নি।

তিনি জোর দাবি জানিয়ে বলেন, তার খাবার ভালো বলেই শিক্ষার্থীরা খান। কারণ ভালো না হলে তিনি বিক্রি করতে পারতেন না।

কথা হয় কয়েকজন শিক্ষার্থীদের সাথেও। তারা বলেন, তারা জানলেও এ ধরণের খাবার খান। তাছাড়া ব্যবসায়ীরাও জানেন খাবের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে। কিন্তু স্বাদের বিবেচনা এবং ঐতিহ্যের কারণে দীর্ঘদিন ধরে টিকে আসে এ ধরণের খাবার।

কিভাবে তৈরি হয় এসব খাবার?

আলোচিত এ মুখোরোচক খাবারগুলো আসলে কিভাবে তৈরি হয় তার খোঁজ নিতে যাওয়া হয় পুরান ঢাকার কামরঙ্গী চর এলাকায়। প্রবেশ করা হয় একটা আইসক্রিমের ফ্যাক্টরিতে। সেখানকার পরিবেশ রিতীমতো চমকে যাওয়ার মতো। কারণ এত নোংরা পরিবেশে যে খাবারও তৈরি হতে পারে তা নিজ চোখে না দেখলে যেন বিশ্বাসই হতে চাইবে না।

এ পরিবেশের আইসক্রিম খেলে যে শিশুদের ক্ষতি হতে পারে এ বিষয়টি স্বীকার করে দায়িত্বরত কর্মীও। দেখা যায় বাসী তেল এবং রং দিয়ে তৈরী করা হয় আইসক্রিম। তাছাড়া চিনির বদলে ব্যবহার করা হয় চিনি সাদৃশ্য অস্বাস্থ্যকর কোন দ্রব্য।

এ ধরণের খাবারে কি হতে পারে সে বিষয়ে কথা হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়ার সাথে। তিনি জানান, এ ধরণের খাবার বাচ্চাদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর মধ্যে ডায়রিয়া, আমাশয়, পেটের ব্যথা, ফুড পয়জনিং কিংবা হজমের অসুবিধা সাধারণ। তাছাড়া এ ধরণের খাবার বেশিদিন ধরে নিয়মিত খাওয়া হলে মলাশয় ক্যান্সার, কিডনিতে পাথরসহ বেশ কিছু বড় ধরণের সমস্যা হতে পারে।

এতোকিছুর পর এখন প্রশ্ন উঠছে এ ধরণের সমস্যা সমাধাণের জন্য কি কখনও কোন ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি?

খোঁজ নিয়ে জানা যায় নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সচ্ছল করতে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ২০১৬ সালে শুরু হওয়া সেই প্রকল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা। যে প্রকল্পটিতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের স্বাস্থ্য সম্মত উপায়ে খাদ্য তৈরি ও বিক্রির পদ্ধতি শেখানো হয়েছিল। কিন্তু দুই বছর পর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ৮০ জনের কোন খোঁজ মেলেনি রাস্তায়।

এমতাবস্থায় একজনের সাথে দেখা হয় পথে। তিনি জানান, তিনি শাহবাগে চটপট্টি বিক্রি করতেন। কিন্তু তৎকালীন সময় দেশে আন্দোলন চলছিল। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে গাড়ি দেওয়া হলেও গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামতে পারতেন না তারা। নানান সময় শিকার হতে হতো বিভিন্ন ধরণের হয়রানির। যার ফলে বাধ্য হয়েই এ ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হয় তাদের।

কিন্তু কেন এমনটা হলো? এ বিষয়ে কথা হয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশের দায়িত্বরত কর্তৃপক্ষের সাথে। তুলে ধরা হয় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ।

সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হয় যানজটসহ বেশ কিছু সমস্যার কারণে উদ্যোগ নিয়েও ব্যবসা করতে দেওয়া হয়নি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের।

তার মানে সমন্বয়ের অভাবে শুরু হতে না হতেই ভেস্তে গেছে পুরো প্রকল্প। তবে এটাও ঠিক স্বাস্থ্য সম্মত খাবারও যেমন দরকার তেমন দরকার নিরাপদ জীবন ব্যবস্থার। এখন কি করবেন সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনাকেই!

(এই লেখাটি বেসরকারি একটি টেলিভিশনের অনুসন্ধানমূল ইনভেস্টিগেশন থ্রি সিক্সটি ডিগ্রী অনুষ্ঠানের একটি পর্ব অবলম্বনে করা)

বিডি২৪লাইভ/এইচকে/এমআর

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: