চিরনিদ্রায় শায়িত অগ্নিবীর সোহেল রানা

প্রকাশিত: ০৯ এপ্রিল ২০১৯, ১০:০৪ পিএম

বনানীর অগ্নিবীর সোহেল রানার মরদেহ আসছে কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলার চৌগাংগা ইউনিয়নের কেরুয়ালা গ্রামের বাড়িতে। এই খবরে মঙ্গলবার (৯ এপ্রিল) সকাল থেকেই বাড়িতে ঢল নামে শোকাহত হাজারো মানুষের।

বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজনসহ শোকাহত জনতার ব্যাকুল প্রতীক্ষা! নিজের জীবন দিয়ে অন্যদের জীবন বাঁচানো মানুষটিকে শেষ বিদায়ের সময় একনজর দেখে, একটু ছুঁয়ে দেখতে চান তারা। দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে বিকাল ৫টায় যমুনা নামের একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে সোহেল রানার মরদেহ পৌঁছায় কেরুয়ালা গ্রামের বাড়িতে।

ঢাকা থেকে বাড়ি পর্যন্ত সোহেলের মরদেহের সাথে ছিলেন ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা মিন্টু, ভগ্নিপতি জসিমউদ্দিন ও ছোট ভাই উজ্জ্বল মিয়া। অ্যাম্বুলেন্স থেকে নিথর দেহে কফিনবন্দী সোহেলকে বাড়ির আঙিনায় নিয়ে রাখার সময় এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সোহেলের মা, বাবা, ভাইবোন ও স্বজনদের কান্না আর আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে এলাকার পরিবেশ।

ছেলের কফিন আঁকড়ে মা হালিমা খাতুনের বিলাপ, ছোট দুই ভাই রুবেল ও দেলোয়ারের কান্না, বড় বোন সেলিনার আহাজারি আর নির্বাক বাবা নূরুল ইসলামের বোবা কান্না ছুঁয়ে যায় সবাইকে। সোহেলকে দেখতে আসা অন্যদের চোখেও তখন জল। সেখান থেকে বিকাল ৫টা ৩৫ মিনিটে সোহেল রানার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় চৌগাংগা পুরান বাজার সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা সংলগ্ন খোলা মাঠে। সেখানে ৫টা ৪০ মিনিটে অনুষ্ঠিত হয় সোহেলের দ্বিতীয় ও শেষ নামাজে জানাজা। জানাজার আগে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানান তাদের অগ্নিবীরকে। সোহেল রানার জন্য দোয়া চেয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন চাচা রতন মিয়া। জানাজায় জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী, পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ বিপিএম (বার), ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক মো. দুলাল মিয়া, ইটনা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান চৌধুরী কামরুল হাসানসহ কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেন। পরে সন্ধ্যা ৬টায় বাড়ির আঙিনায় সোহেল রানার নিজের লাগানো শিমুল গাছের নিচে খনন করা কবরে সমাহিত করা হয় অন্যের জীবন বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবনদানকারী এই ‘রিয়েল হিরোকে’।

জানাজায় অংশ নেয়ার আগে জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী বলেন, সোহেল রানা একজন বীর। তিনি বনানী এফআর ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অনেককে বাঁচিয়েছেন। কিন্তু তিনি জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেলেন যে, কর্তব্যের কাছে তিনি কত বড়। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে সোহেল রানার পরিবারকে নগদ ৫০ হাজার টাকা প্রদান করা হবে। পরবর্তিতে সরকারি তরফ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা করা হবে।

জেলা প্রশাসক আরও বলেন, সোহেল রানার মৃত্যুতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পৃথক শোক প্রকাশ করেছেন। সোহেল রানা তার জীবন উৎসর্গ করে তিনি যে নজীর স্থাপন করে গেছেন, সেটা সবার মাঝে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।

পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ বিপিএম (বার) বলেন, সোহেল রানা মানুষকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবন দিয়ে জাতীয় বীরের পরিচয় দিয়েছেন। এই জন্য আমি বাংলাদেশ পুলিশ ও কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে তাকে স্যালুট জানাই।

এর আগে মঙ্গলবার বেলা সোয়া ১১টায় ফায়ার সার্ভিস সদরদপ্তরে সোহেল রানার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার আগে সকালে কুর্মিটোলা ফায়ার স্টেশনের ফায়ারম্যান সোহেল রানাকে সম্মান জানানো হয়। বিউগলের সুর বাজিয়ে ফায়ার সার্ভিসের পতাকায় মোড়ানো সোহেল রানার কফিনে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ফায়ার সার্ভিসের চৌকস দল। গত ২৮শে মার্চ বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে আটকা পড়াদের জীবন বাঁচাতে গিয়ে গুরুতর আহত হন ফায়ারম্যান সোহেল রানা।

তারপর থেকে সিএমএইচে আইসিইউতে ভেন্টিলেশনে রেখে তাকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল। অবস্থার আশানুরূপ উন্নতি না হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গত শুক্রবার (৫ই এপ্রিল) সন্ধ্যায় এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সোহেল রানাকে সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়। কিন্তু চিকিৎসকদের প্রাণান্ত চেষ্টা আর দেশবাসীর অফুরান প্রার্থনাকে ব্যর্থ করে দিয়ে তিনি চলে যান না ফেরার দেশে।

সোমবার (৮ই এপ্রিল) বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ১৭ মিনিটে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান ফায়ার ফাইটার সোহেল রানা। পরে সোমবার সন্ধ্যায় নিহত সোহেল রানার মরদেহ সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। রাত ১০টা ৪০ মিনিটের দিকে সোহেল রানাকে বহনকারী সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটটি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। রাতে মরদেহ রাখা হয় রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) মর্চুয়ারিতে।

বিডি২৪লাইভ/এজে

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: