জঙ্গি হামলা, পুলিশের মুখে নির্মম-হৃদয় বিদারক গল্প

প্রকাশিত: ১১ এপ্রিল ২০১৯, ১০:৪৬ এএম

জঙ্গি হামলায় গুরুতর আহত হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন তিনি। মৃত্যুর হাত থেকে তিনি যেন বেঁচে আছেন। পাঁচ-পাঁচটি অপারেশন ও সারা শরীরের ইনজেকশন এর দাগ এখনও শরীর থেকে মুছে যায়নি। হাতের আঙ্গুলে পচন শুরু হলে বাম হাতের একটি আঙ্গুল কেটে ফেলতে হয়েছে। বুকে-পেটে গুলিবিদ্ধ ও চাপাতির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত দেহের অবয়ব ফিরিয়ে আনতে বড় ধরণের পাঁচটি অপারেশন করা হয়। এভাবে প্রায় তিন বছর দীর্ঘ চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে তার কর্মস্থলে ফিরে এসেছেন।

মঙ্গলবার (১০ এপ্রিল) চিকিৎসা ব্যয়ের সর্বশেষ আড়াই লাখ টাকার চেকটি গ্রহণ করতে তিনি কিশোরগঞ্জ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে এসেছিলেন। এ সময় কথা হয় সেই বেঁচে যাওয়া পুলিশ কনস্টেবল রফিকুল ইসলাম (নং-১০৯২) সাথে।

২০১৬ সালের ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ময়দানের জঙ্গি হামলার শিকার হয়ে গুরুতর আহত রফিকুলের বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দিয়েছিল পরিবারের সবাই।

সেদিনের ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ঘটনার কথা স্মরণ করতে গিয়ে রফিকুল ইসলাম জানান, ঈদের দিন বৃষ্টিহীন সকালে শোলাকিয়া মাঠে নামাজ আদায় করার জন্য ভোরবেলায় মুসুল্লিরা আসতে শুরু করেন। সাড়ে ৮টার মধ্যে শোলাকিয়া মাঠ কানায় কানায় ভরে যায়। মুসুল্লিদের উপচে পড়া ভীরে মাঠ ও আশপাশ এলাকা একাকার।

এমন পরিবেশের মধ্যে ঠিক পৌনে ৯টার দিকে শহরের উকিলপাড়া থেকে রেলক্রসিং পাড় হয়ে শোলাকিয়া ঈদগাহে যাওয়ার পথে আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন পুলিশ চেকপোস্টে আসে ১৯/২০ বছরের দুই তরুণ। তাদের একজনের হাতে ছোট একটি ব্যাগ, আরেকজনের হাতে নামাজ পড়ার জায়নামাজ। পুলিশ তাদের দেহতল্লাশির উদ্যোগ নেওয়ার সময় তারা বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ও চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ও গুলি করে  চেকপোষ্টে দায়িত্বরত ১১ পুলিশ সদস্যকে আহত করে। হামলাকারীরা অসম্ভব প্রিতার সঙ্গে পুলিশের ওপর এই হামলা চালায়।

রফিক জানান, ঢাকা সিএমএইচ এ জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর তিনি জানতে পারেন ১১ জন পুলিশ সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর আহত তিনজনের মধ্যে তিনি একজন। তাঁর দুই সহকর্মী কনস্টেবল জহিরুল হক ও আনসারুল হক ইতোমধ্যে মারা গেছেন। এ কথা শোনার পর তার মাথা কাজ করছিল না। তার মনে আশঙ্কা তৈরি হয়, অন্য দুইজনের মতো তাকেও বিদায় নিতে হবে।

রফিকুল ইসলাম আরো জানান, তাকে প্রথমে কিশোরগঞ্জ ২৫০ শয্যার হাসপাতাল থেকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখান থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় হেলিকপ্টারে করে ঢাকা সিএমএইচ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রায় দুই বছর তাকে চিকিৎসা নিতে হয়। অপারেশন করে পেটে বিদ্ধ গুলি বের করা হলেও শরীরের বিভিন্ন স্থান ক্ষত-বিক্ষত থাকায় তার শরীরে আরও চারটি বড় ধরণের অপারেশন করা হয়। বা হাতের আঙ্গুলে পচন ধরে। এক পর্যায়ে একটি আঙ্গুল কেটে ফেলতে হয়।

তারপরও তার শরীরের অর্থোপেডিক সহ নানা সমস্যার কারণে তিনি চলাফেরা করতে পারতেন না। পরে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চলে তার চিকিৎসা। সেখান থেকে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে আরও দুই মাস বিশ্রামে থাকার পর তিনি সুস্থ হয়ে কর্মক্ষেত্র কিশোরগঞ্জ পুলিশ লাইনে ১৫দিন আগে যোগদান করেছেন। তিনি বর্তমানে দাপ্তরিক কাজ করছেন।

রফিকুল ইসলাম আরও জানান, তিনি যখন আহত হয়ে যখন জীবন-মৃত্যুর কাছাকাছি। তখন তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী নেভি আক্তার অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। তার মুমূর্ষু অবস্থার কথা জেনে স্ত্রী মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। তার ধারণা গর্ভের সন্তান আর স্ত্রীর দোয়াতেই আল্লাহ-তাআলা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। না হলে তার অপর দুই সহকর্মীর মতো তাকেও পরজগতে চলে যেতে হতো।

চিকিৎসাধীন অবস্থায় রফিকুল যখন হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন শোলাকিয়া জঙ্গি হামলার ঠিক ১৫ দিন পর স্ত্রী নেভি আক্তার একটি কন্যা সন্তান জন্ম দেন। কন্যা শিশুটির জন্যই মহান সৃষ্টিকর্তার রহমত বর্ষিত হওয়ায় তার বেঁচে থাকা বলে তার স্ত্রী নেভি আক্তারও মনে করেন।

কন্যা শিশুটির বয়স তিন বছর হতে চলছে। শিশুটির নাম তাসলিম জাহান রাইসা। রাইসার দিকে তাকালে তিনি সবকিছু ভুলে যান। এখনও তাকে মাঝেমধ্যে চিকিৎসা নিতে হয়। তাছাড়া তার বাবা-মা রয়েছেন। তাদেরও দেখভাল করতে হয়।

রফিকুল তার চিকিৎসার জন্য সরকারসহ পুলিশ বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, সরকার এবং স্যাররা আমার পাশে না থাকলে আমার এ জীবনে ফিরে আসা সম্ভব হতো না।

নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার পতেহ ইটারবাড়ি গ্রামের আবদুল হামিদের ছেলে রফিকুল। শোলাকিয়া জঙ্গি হামলার ঘটনায় তিনি পিপিএম পদক লাভ করেন ২০১৭ সালে।

বিডি২৪লাইভ/টিএএফ

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: