ঈদুল আজহার আর মাত্র কয়েক ঘন্টা বাকি। ঈদুল আজহা মূলত মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু কোরবানি করা হয়ে থাকে।
নিজের কোরবানির পশু নিজেই জবাই করা মুস্তাহাব। যদি নিজের দ্বারা জবাই সম্ভব না হয় তবে অন্যের দ্বারা জবাই করানো। এক্ষেত্রে জবাইয়ের সময় কোরবানি দাতা সামনে থাকা উত্তম।
কোরবানির পশু জবাইয়ের আগে কিছু নিয়ম জানা জরুরি। আসুন জেনে নেই কোরবানির পশু জবাইয়ের নিয়ম ও দোয়া।
জবাই বা নহরের পদ্ধতি
বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার
জবাই করার সময় পশু ক্বিবলামুখী করে শোয়ানো। অতঃপর (بِسْمِ اللهِ اَللهُ اَكْبَر) বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে জবাই করা।
বিসমিল্লাহ:
ইচ্ছাকৃতভাবে বিসমিল্লাহ বলা পরিত্যাগ করলে জবাইকৃত পশু হারাম বলে গণ্য হবে। আর যদি ভুলবশত বিসমিল্লাহ ছেড়ে দেয় তবে তা খাওয়া বৈধ।
কোরবানির শুদ্ধ:
জবাই করার সময় কণ্ঠনালী, খাদ্যনালী, এবং উভয় পাশের দুটি রগ অর্থাৎ মোট চারটি রগ কাটা জরুরি। কমপক্ষে তিন যদি তিনটি রগ কটা হয় তবে কোরবানির শুদ্ধ হবে। কিন্তু যদি দু’টি রগ কাটা হয় তবে কুরবানি দুরস্ত হবে না। (হিদায়া)
ছুরি ভালভাবে ধার দেয়া:
জবাই করার সময় ছুরি ভালভাবে ধার দিয়ে নেয়া, যাতে জবাইয়ের সময় পশুর অপ্রয়োজনীয় কষ্ট না হয়। যেমন- এক ছুরি দিয়ে জবাই শুরু করে চামড়া কিছু কাটার পর আর না কাটা অতপর আবার ছুরি পরিবর্তন করে জবাই করা ইত্যাদি।
কোনো ব্যক্তি জবাই করার সময় জবাইকারীর ছুরি চালানোর জন্য সাহায্য করে, তবে তাকেও বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলা।
কোরবানির পশু জবেহের দোয়া:
কোরবানির পশু জবাই করার সময় মুখে (উচ্চ স্বরে) নিয়ত করা জরুরি নয়। অবশ্য মনে মনে নিয়ত এ নিয়ত করা যে, ‘আমি আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোরবানি আদায় করছি। তবে মুখে দোয়া পড়া উত্তম।
কোরবানির পশু ক্বিবলার দিকে শোয়ানোর পর এ দোয়া পাঠ করা:
উচ্চারণ- ইন্নি ওয়াঝঝাহতু ওয়াঝহিয়া লিল্লাজি ফাতারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা হানিফাও ওয়া মা আনা মিনাল মুশরিকিন। ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন। লা শারিকা লাহু ওয়া বি-জালিকা উমিরতু ওয়া আনা মিনাল মুসলিমিন। আল্লাহুম্মা মিনকা ও লাকা।
অতঃপর ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে কুরবানির পশু জবাই করা।
কোরবানির পশু জবাই করে এ দোয়া পড়া-
উচ্চারণ
আল্লাহুম্মা তাকাব্বালহু মিন্নি কামা তাকাব্বালতা মিন হাবিবিকা মুহাম্মাদিও ওয়া খালিলিকা ইবরাহিমা আলাইহিমাস সালাতা ওয়াস সালাম।
লক্ষ্যণীয় হলো- যদি কেউ একাকি কোরবানি দেয় এবং নিজে জবাই করে তবে বলবে মিন্নি; আর অন্যের কোরবানির পশু জবাই করার সময় ‘মিন’ বলে যারা কোরবানি আদায় করছে তাদের নাম বলা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে উল্লেখিত নিয়মে কোরবানি আদায় করার তাওফিক দান করুন। সবার কোরবানিকে কবুল করুন।।
জবাই করার সময় যে বিষয়গুলো লক্ষণীয়:
১. পশুর প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করা। এমন ব্যবস্থা নিয়ে জবাই করা, যাতে পশুর অধিক কষ্ট না হয় এবং সহজেই প্রাণ ত্যাগ করতে পারে। খুব তীক্ষ্ম ধারালো ছুরি দ্বারা জবাই করা। সাহাবি শাদ্দাদ ইবনু আউস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। নবী (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা সকল বিষয়ে সকলের সঙ্গে সুন্দর ও কল্যাণকর আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব, তোমরা যখন হত্যা করবে তখন সুন্দরভাবে করবে আর যখন জবাই করবে তখনো তা সুন্দরভাবে করবে। তোমরা ছুরি ধারালো করে নেবে, যেন খুব সহজেই জবাই হয়ে যায়। (মুসলিম, আসসাহিহ : ১৯৫৫)। বধ্য পশুর সামনেই ছুরি শান দেয়া উচিত নয়। (ইবনু মাজাহ, আসসুনান : ৩১৭২)। একইভাবে, একটি পশুকে অন্য একটি পশুর সামনে যবেহ করা এবং ছেচরে যবেহ স্থানে টেনে নিয়ে যাওয়াও মাকরুহ।
২. কোরবানির পশু যদি উট হয় (অথবা এমন কোনো পশু হয় যাকে আয়ত্ব করা সম্ভব নয়) তাহলে তাকে বাম পা বাধা অবস্থায় দাঁড় করিয়ে নহর করা হবে। (সূরা: হজ, আয়াত: ৩৬)।
যদি উট ছাড়া অন্যপশু হয় তাহলে তা বাম কাতে শোয়াবস্থায় যবেহ করা হবে। যেহেতু তা সহজ এবং ডান কাতে ছুরি নিয়ে বাম হাত দ্বারা মাথায় চাপ দিয়ে ধরতে সুবিধা হবে। সম্ভব হলে পশুকে ডানকাতে শুইয়ে জবাই করার চেষ্টা করতে হবে। এক্ষেত্রে পশুকে আরাম দেয়াই উদ্দেশ্যে। পশুর গর্দানের এক প্রান্তে পা রেখে জবাই করা মুস্তাহাব। যাতে পশুকে অনায়াসে কাবু করা যায়। কিন্তু গর্দানের পিছনদিকে পা মুচড়ে ধরা বৈধ নয়। কারণ, তাতে পশু অধিক কষ্ট পায়।
৩. জবাইকালে পশুকে কিবলামুখী করে শয়ন করানো উচিত। অন্যমুখে শুইয়েও জবাই করা শুদ্ধ হবে। (ইবনু উসাইমিন, আহকামুল উযহিয়্যাহ, পৃ. ৮৮-৯৫)।
৪. জবাই করার সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বলতে হবে। কারণ, এটা বলা ওয়াজিব। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
فَكُلُواْ مِمَّا ذُكِرَ ٱسْمُ ٱللَّهِ عَلَيْهِ
‘যার ওপর আল্লাহর নাম (বিসমিল্লাহ) উচ্চারণ করা হয়েছে তা থেকে তোমরা আহার করো।’ (সূরা: আনয়াম, আয়াত: ১১৮)।
হাদিসে এসেছে- রাসূলুল্লাহ (সা.) দুটি শিংওয়ালা ভেড়া জবাই করলেন, তখন ‘বিসমিল্লাহ’ ও আল্লাহু আকবার’ বললেন। (দারিমি, আসসুনান : ১৯৮৮)।
‘বিসমিল্লাহ’ ও ‘আল্লাহু আকবার’ পাঠের পর اللَّهُمَّ مِنْكَ وَلَكَ ‘হে আল্লাহ এটা তোমার তরফ থেকে তোমারই জন্য।’ বলা যেতে পারে। যার পক্ষ থেকে কোরবানি করা হচ্ছে তার নাম উল্লেখ করে দুয়া করা জায়েয আছে। এভাবে বলা যেতে পারে, ‘হে আল্লাহ তুমি অমুকের পক্ষ থেকে কবুল করে নাও।’
মূলত কোরবানি কেবল নিজের তরফ থেকে হলে বলবে, ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা ইন্না হাযা মিনকা ওয়ালাকা, আল্লাহুম্মা তাকাব্বাল মিন্নি।’ নিজের এবং পরিবারের তরফ থেকে হলে বলবে, ‘....তাকাবাল্লাহ মিন্নি ওয়ামিন আহলি বাইতি।’ অপরের নামে হলে বলবে, ‘তাকাব্বাল মিন...(এখানে যার তরফ থেকে কোরবানি তার নাম নেবে)’। (আলবানি, মানাসিকুল হাজ্জ, পৃ. ৩)।
৫. রক্ত প্রবাহিত হওয়া জরুরি। আর তা দুই শাহরগ (কণ্ঠনালির দু’পাশে দুটি মোটা আকারের শিরা) কাটলে অধিকরূপে সম্ভর হয়। রক্ত প্রবাহিত ও শুদ্ধ জবেহ হওয়ার জন্য চারটি অঙ্গ কাটা জরুরি- শ্বাসনালী, খাদ্যনালী এবং পার্শ্বস্থ দুটি মোটা শিরা।
৬. প্রাণ ত্যাগ করার পূর্বে পশুর অন্য কোনো অঙ্গ কেটে কষ্ট দেয়া হারাম। যেমন ঘাড় মটকানো, পায়ের শিরা কাটা, চামড়া ছাড়ানো ইত্যাদি জান যাওয়ার আগে বৈধ নয়। একইভাবে, দেহ আড়ষ্ট হয়ে এলে চামড়া ছাড়াতে শুরু করার পর যদি পুনরায় লাফিয়ে ওঠে, তাহলে আরো কিছুক্ষণ প্রাণ ত্যাগ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। যেহেতু পশুকে কষ্ট দেয়া বৈধ নয়। পশু পালিয়ে যাওয়ার ভয় থাকলেও ঘাড় মটকানো যাবে না। বরং তার বদলে কিছুক্ষণ চেপে ধরে রাখা যায়।
যবেহ করার সময় পশুর মাথা যাতে বিচ্ছিন্ন না হয় খেয়াল করা উচিত। তা সত্ত্বেও যদি কেটে বিচ্ছিন্ন হয়েই যায়, তাহলে তা হালাল হওয়ার ব্যাপাবে কোনো সন্দেহ নেই।
যবাই ছেড়ে দেয়ার পর (অসম্পূর্ণ হওয়ার ফলে) কোনো পশু উঠে পালিয়ে গেলে তাকে ধরে পুনরায় জবাই করা যায়। নইলে কিছু পরেই সে এমনিতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে।
যবেহ করার জন্য পবিত্রতা বা জবাইকারীকে পুরুষ হওয়া শর্ত নয়। মাথায় টুপি রাখা বা মাথা ঢাকাও বিধিবদ্ধ নয়। তবে ঈমানের পবিত্রতা জরুরি। কাফির, মুশরিক ও বেনামাজির হাতের জবাই শুদ্ধ নয়।
উল্লেখ্য, যবেহকৃত পশুর রক্ত হারাম। অতএব তা কোনো ফল লাভের উদ্দেশ পায়ে মাখা, দেওয়ালে ছাপ দেয়া বা তা নিয়ে ছুড়াছুড়ি করে খেলা করা বৈধ নয়।
পাঠকের মন্তব্য: