ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে অর্থনীতি

প্রকাশিত: ২২ মার্চ ২০২০, ০৬:৩৭ এএম
ভয়ঙ্কর ভাইরাস কোভিট-১৯ বা করোনার থাবায় ক্রমেই সংকটাপন্ন হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। প্রথমে চীনে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে আমদানিতে সংকট তৈরী হয়। তবে, এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় সংকুচিত হয়েছে রপ্তানি বাণিজ্য। ফলে রপ্তানিমুখী খাত, সেবা খাত এবং প্রবাসী আয়ে চরম অনিশ্চয়তা তৈরী হয়েছে। এমন অবস্থায়, স্থানীয় উৎপাদন কমলে কর্মসংস্থান কমে যেতে পারে, পাশাপাশি বড় হয়ে সামনে আসছে বাজার হারানোর শঙ্কাও। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, প্রতি মুহূর্তে পাল্টাচ্ছে দৃশ্যপট। চীনের অর্থনীতি যেহেতু আবার সচল হচ্ছে, তাই যোগানের ঝুঁকিটা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। এখন সবচেয়ে বড় ঝুঁকি চাহিার ক্ষেত্রে; কারণ ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডার অর্থনীতি বন্ধ; তাই রপ্তানিমুখী শিল্প খাত ঝুঁকিতে পড়েছে। প্রশ্নটা হচ্ছে, করোনার ভয়াবহতা কতো দিন ধরে চলবে তার ওপর সব কিছু নির্ভর করবে। কারণ সময় নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না কবে নাগাদ সব কিছু সচল হবে। আমদানিতে ক্ষত: চীন থেকে আমদানি করা হয় গার্মেন্টস-এর ওভেন খাতের প্রায় ৬০ শতাংশ ফেব্রিক্স। নিট খাতের ১৫-২০ শতাংশ কাঁচামাল আর নিট ডাইং-এর কেমিকেল এবং এক্সেসরিজের ৮০ ভাগ আমদানির ক্ষেত্রে চীন নির্ভর বাংলাদেশ। কিন্তু করোনা ভাইরাসের প্রার্দুভাবে বলা যায় বন্ধ রয়েছে সবধরণের আমদানি বাণিজ্য। ট্যারিফ কমিশনের অন্তবর্তীকালীন প্রতিবেদনে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষতির দিকটি তুলে আনা হয়। ওই রিপোর্টে বলা হয়, করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিতে তৈরী পোশাক খাত। বলা হচ্ছে, চামড়া খাতে ক্ষতির পরিমাণ তিন হাজার কোটি টাকা। গার্মেন্টস এক্সেসরিজ খাতের সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। বছরে প্রায় সাড়ে ৫০০ কোটি টাকার জুট স্পিনার্স জাতীয় পণ্য চীনে রপ্তানি করে বাংলাদেশ। কিন্তু জাহাজীকরণ বন্ধ থাকায় হুমকির মুখে পাট রপ্তানি। এছাড়া মুদ্রণ শিল্পে ক্ষতির পরিমাণ ৩৬০ কোটি ডলার। কম্পিউটার খাতে যন্ত্রাংশ না আসায় ইতিমধ্যেই পণ্যের সংকট তৈরী হয়েছে। ইলেকট্রনিক্স পণ্যের ক্ষেত্রেও বাড়ছে চাহিদা। বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহকারি মহাসচিব আল মামুন মৃধা, জানান, উৎপাদনের ক্ষেত্রে এমন কিছু নেই যার কাঁচামাল চীন থেকে আসে না। করোনার কারণে আমদানি প্রায় বন্ধই ছিল। তবে, এখন ধীরে ধীরে তা চালু হতে শুরু করেছে। রপ্তানিতে শঙ্কা : আমদানি খাতের ক্ষতির পর এখন বড় চিন্তার জায়গা রপ্তানি খাত। তৈরী পোশাক খাতে লাখ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান নিয়ে তৈরী হয়েছে অনিশ্চিন্তা। পণ্য উৎপান করেও তা গন্তব্যে পৌঁছানোটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। সূত্র বলছে, একের পর এক বাতিল হচ্ছে তৈরী পোশাকের ক্রয়াদেশ। বিজিএমইএ’র হিসেবে এরই মধ্যে ৩০ শতাংশ ক্রয়াদেশ বাতিল হয়ে গেছে, এতে শেষ পর্যন্ত কতোগুলো কারখানা চালু রাখা যাবে বা কতো শ্রমিক কর্মসংস্থান হারাবে তা বলা কঠিন। তৈরী পোশাক মালিকদের শীর্ষ সংগঠন, বিজিএমইএ সূত্র জানায়, করোনা মহামারির কারণে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে উৎপাদিত পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্রেতা বাতিল অথবা স্থগিত করছেন ক্রয়াদেশ। এতে বিপদের মুখে কারখানা মালিকরা। আমদানিকৃত কাঁচামালের দাম থেকে শ্রমিকের মজুরি সবই দিতে হয় নিজের অর্থে। সার্বিক পরিস্থিতিতে উৎকণ্ঠায় এ খাতের উদ্যোক্তারা। দেশের বস্ত্রখাতের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপ। ৭০ শতাংশ নিটওয়্যারের গন্তব্য সেখানে। আমেরিকায় যায় ১০ থেকে ১২ শতাংশ। বাকিটা বিশ্বের অন্যান্য দেশে। ওইসব দেশ থেকে ক্রয়াদেশ বাতিল করা হলেও, এখনই কারখানা বন্ধের ঝুঁকি নিতে চান না গার্মেন্টস মালিকরা। তবে, পরিস্থিতি সামাল দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহযোগিতা চান বিজিএমইএ’র নেতারা। বলছেন, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে আর্থিক সহযোগিতা এ মুহূর্তে প্রয়োজন। বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক জানান, উৎপাদন চালিয়ে যেতে, এই মুহূর্তে সরকারের সহযোগিতায় ‘ডিজাস্টার রিলিফ ফান্ড’ গঠন দরকার। চামড়া খাতের ক্ষতিও অনেক বড়। রপ্তানি করতে না পারায় ট্যানারিগুলোতে এখন মজুত রয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার চামড়া। আর শুধু চীনা ক্রেতাদের চাহিদাকৃত ১২০ কোটি টাকা চামড়া মজুত রয়েছে। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ জানান, দ্রুত সময়ের মধ্যে অবস্থার পরিবর্তন না হলে ট্যানারি মালিকরা ঋণ খেলাপি হবে। অ্যাভিয়েশন খাতে বড় ক্ষতি : করোনায় বড় ধরণের ক্ষতির মুখে অ্যাভিয়েশন খাত। রাষ্ট্রায়ত্ব উড়োজাহাজ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের চলতি মাসের শেষ পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ দাড়িয়েছে প্রায় তিনশ কোটি টাকা। এখন মাত্র তিনটি দেশের চারটি গন্তব্যে ২৮টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে এই প্রতিষ্ঠান। ফ্লাইট কমেছে ড়েশ’র বেশি। অভ্যন্তরীণ রুটেও যাত্রী না পাওয়া যাওয়ায় প্রতিদিনই বাতিল হচ্ছে ফ্লাইট। শুধু যাত্রীই নয়, কার্গো হ্যান্ডেলিংসহ অন্যান্য সেবা না দেবার কারণে বিমানের ক্ষতি বাড়ছে। অন্যদিকে, বেসরকারি উড়োজাহাজ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ইউএস বাংলা’রও অবস্থা শোচনীয়। আন্তর্জাতিক বেশিরভাগ রুটেই এখন চলাচল বন্ধ। অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রী কমেছে অর্ধেক। একই অবস্থা নভোএয়োরের ক্ষেত্রেও। এই প্রতিষ্ঠানের কোলকাতা রুট বন্ধ হয়ে গেছে, অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রী কমেছে ৩০ ভাগ। বিনিয়োগে খরা : এমনিতেই দেশে বিদেশি বিনিয়োগ মন্দা। তারওপর করোনা ভাইরাসের কারণে থমকে গেছে বিদেশি বিনিয়োগ নিবন্ধন। নতুন কোনো উদ্যোক্তা দেশে আসতে পারছে না। নিকট সময়ে আসারও কোনো সম্ভাবনা নেই। ফলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘকালীন সংকট তৈরী হবে। মির্জা অ্যাসোসিয়েটস’র সিইও নাঈম মাহমু মির্জা জানান, আগে বিভিন্ন দেশ থেকে বিনিয়োগকারীরা এসে নানাভাবে এদেশ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতো। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সম্ভাবনা এবং সুযোগ তৈরী হতো। কিন্তু এখন কেউ যোগাযোগ করে না। ফলে চলতি অর্থবছরে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো সম্ভাবনা নেই। অর্থায়নে চিন্তা : করোনা মোকাবেলায় প্রয়োজন অর্থ। কিন্তু অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থায়ন খুবই চ্যালেঞ্জিং। রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে ধারাবাহিক মন্দার কারণে এমনিতেই চাপের মুখে সরকার। ঋণ নেবার ক্ষেত্রে এক মাত্র ভরসা ব্যাংক খাত। কিন্তু ব্যয় ব্যবস্থাপনা সামাল দিতে ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে সরকার। নিয়ন্ত্রণের কারণে কমে গেছে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণও। সূত্র জানিয়েছে, করোনা মোকাবেলার ব্যয় নির্বাহের প্রয়োজনে শ্লথ হতে পারে উন্নয়ন কর্মকান্ড। তবে বিকল্প উৎস বিশ্বব্যাংক, এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক বা এডিবিসহ বেশ কয়েকটি ঋণদাতা সংস্থা করোনা ফান্ড তৈরী করেছে। সেইসব ঋণ বা সহায়তা নেবার ক্ষেত্রে এখনই প্রস্তুতি প্রয়োজন। বিশ্বব্যাংকের ড. জাহি হোসেন বলেন, অর্থায়ন এখন খুবই রকার। কারণ প্রান্তিক পর্যায়ে কর্মসংস্থানের সংকট হলে তারে সহায়তা দেবার জন্য অর্থ প্রয়োজন।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: