ভয়াবহ দূষণের কবলে নদী খাল, হুমকির মুখে জলজ প্রাণি ও পানির উৎস

প্রকাশিত: ০৬ মে ২০২১, ০৮:৩০ পিএম
বংশাই ও লৌহজং নদী। এক সময় এই নদীর পানি ছিল টলমল ছিল স্বচ্ছ। অবলম্বন ছিল জীবন-জীবিকার। মৃত প্রায় এই নদীর বুকে দ্রুত শেষ পেরেক ঠুকে দেয়ার জন্যই বিরামহীন ফেলা হচ্ছে কারখানার তরল বর্জ্য। আর এই বর্জ্যই টাঙ্গাইলের মির্জাপুরকে উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে ঘিরে রেখেছে ও দূষণের চরম মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে নদীর পানি। শিল্প-কারখানার বর্জ্যে মির্জাপুরের লাইফলাইন খ্যাত বংশাই ও লৌহজং নদী ভয়াবহ দূষণের কবলে। সম্প্রতি একটি গবেষণায় উঠে এসেছে এ দূষণের চিত্র। ছয়টি প্যারামিটারের সবকটিই গ্রহণ যোগ্য মান-দন্ডের চেয়ে অনেক বেশি। গবেষকরা বলছেন, ‘দূষণের মাত্রা সহনীয় পর্যায় না আনলে হুমকির মুখে পড়বে জলজ প্রাণি ও পানির উৎস। মির্জাপুরের লৌহজং, বংশাই নদী ও গোড়াই এলাকার সোহাগপুর খালের প্রবাহ পথে গড়ে উঠেছে অনেক কল-কারখানা। কারখানার বর্জ্য-ময়লা দুর্গন্ধ ও রঙিন বিষাক্ত পানি ফেলা হচ্ছে নদী ও খালে। টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক, সম্প্রতি নদীগুলোর কোদালিয়া, বহুরিয়া ও সোহাড়পুর খালের তিনটি এলাকার পানি সংগ্রহ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। এতে ওঠে আসে দূষণের সবকটি প্যারামিটারের ভয়াবহ চিত্র। পানি সংগ্রহের পরীক্ষা-নিরীক্ষা: ১. লৌহজং, বংশাই ও সোহাগপুর খালের পানিতে অম্লত্ব ও ক্ষারত্বের পরিমাণ ৭ এর ওপর। যা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানদন্ডের মধ্যেই পড়ে। তবে এই মাত্রা সাড়ে ৯ এর বেশি হলে পানিতে মুক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড থাকতে পারে না। ২. পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের গ্রহণযোগ্য ন্যুতম মাত্রা প্রতি লিটারে ৬ মিলিগ্রাম। কিন্তু গবেষণাধীন নদীগুলোতে এর পরিমাণ অনেক কম। এ কারণে ব্যাকটেরিয়া কাজ বন্ধ করে দেয় এবং অ্যামোনিয়া বেড়ে মারা পড়ছে মাছ। ৩. পানিতে জৈব রাসায়নিক অক্সিজেন চাহিদার গ্রহণযোগ্য মাত্রা প্রতি লিটারে শূন্য দশমিক ২ মিলিগ্রাম। এই মাত্রা লৌহজং, বংশাই ও সোহাগপুর খালে অনেকগুন বেশি। যা জলজ জীবের বসবাস অনুপযোগী ও বাস্তুসংস্থানের জন্য ক্ষতিকর। ৪. পানিতে রাসায়নিক অক্সিজেন বা জৈব দূষকের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৪ দশমিক ৫। অথচ লৌহজং নদীতে প্রতি লিটারে ৫৪, বংশাইয়ে ৪৪৫ এবং সোহাগপুর খালে ৭২ মিলিগ্রাম। ৫. টোটাল ডিজলভড সলিড বা টিডিএস যত কম-পানি তত পরিষ্কার। এর সহনীয় মাত্রা ৫০০ মিলিগ্রাম। নদী দুটিতে এই মাত্রা অনেক কম। তবে সোহাগপুর খালে এই মাত্রা হাজারের বেশি। এর কারণে পানিতে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে না পারায় বাধাগ্রস্ত হয় সালোকসংশ্লেষণ, মারা যায় জলজ উদ্ভিদ। ৬. পানিতে পর্যাপ্ত দ্রবীভূত আয়ন বেশি থাকলে বৈদ্যুতিক পরিবাহিতা বেড়ে যায়। লৌহজং ও বংশাইয়ে প্রতি সেন্টিমিটারে ৫ থেকে ৭শ’র বেশি মাইক্রোসিজেনস রয়েছে। তবে সোহাগপুর খালে এই মাত্রা গ্রহণযোগ্যের মাত্রার চেয়ে ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি। যা জলজ পরিবেশের জন্য অনুপযোগী। ৭. দ্রবীভূত কঠিন বস্তুর পরিমাণ বেশি থাকলে জলজ প্রাণির শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। গবেষণায় দেখা গেছে- এসব নদীতে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অনেকগুন বেশি কঠিন বস্তু রয়েছে। গেল বছর মির্জাপুরের লৌহজং, বংশাই নদী ও সোহাগপুর খাল দূষণের জন্য বড় তিনটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ জানান স্থানীয়রা। তবে তদন্তে তাদের বিরুদ্ধে দূষণের দায় পায়নি কর্তৃপক্ষ। এমনকি নদীতে কারখানার পরিশোধিত বর্জ্য ফেলা হয় বলে দাবি প্রতিষ্ঠানগুলোর। অথচ গবেষণা তথ্য বলছে, নদীগুলির পানি মাত্রাতিরিক্ত দূষণের কবলে পড়েছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ মির্জাপুর উপজেলার কোদালিয়ায় অবস্থিত সেই নাসির গ্লাস কয়েক কিলোমিটার কনক্রিটের বড় ড্রেনের মাধ্যমে বংশাই নদীর কোদালিয়া অংশে, গোড়াই শিল্পাঞ্চলে অবস্থিত সাউথ ইস্ট সিমেন্টের পাইপের মাধ্যমে সোহাগপুর খাল ও বংশাই নদীর কোদালিয়া অংশে আর উপজেলার কোট বহুরিয়াতে অবস্থিত মহেড়া পেপার মিল লৌহজং নদীর বহুরিয়া অংশে তরল বর্জ্য ফেলছে। গোড়াই খামার পাড়ার বাসিন্দা সমাজ সেবক বাবুল শিকদার বলেন, ‘গোড়াই এলাকার অনেক কারখানার তরর বর্জ্য ড্রেনের মাধ্যমে সোহাগপুর খালে ফেলা হয়। এই খালটি উত্তর ও দক্ষিণে দুই নদীর সাথে মিলেছে। বর্তমানে ওই খালের পানি দূষণের চরম মাত্রায় পৌঁছে গেছে। নদীর মাছ প্রায়ই মরে ভেসে উঠে। মানুষ গোসলও করতে পারেনা। খালের পানির দুর্গন্ধে বসত-ভিটাতেও টেকা দায় হয়ে পড়েছে।’ বহুরিয়া গ্রামের কমলা বেগম বলেন, ‘আগে আমরা এই নদীতে গোসল করতাম। নদীর পানি ব্যবহার করেই সাংসারিক কাজ করতাম। এখন তা করা যায় না। মহেড়া মিলের বর্জ্য ফেলায় নদীর পানি খারাপ হয়ে গেছে। নদীতে মাছ থাকে না। আর যে মাছ আছে তাও দূর্গন্ধের জন্য খাওয়া যায় না।’ গোড়াইল এলাকার বংশাই নদীর কোদালিয়া এলাকার বাসিন্দা শিরিন আক্তার বলেন, ‘নাসির গ্লাসের বিরুদ্ধে অনেক আন্দোলন হইছে। তারা প্রভাবশালী তাই কোন লাভ হয়নি। তারা নদীতে অবিরত নানা রঙের পানি ফেলে। কখনো কখনো বিষের গন্ধের মতো পানিও আসে। তখন আর বাড়িতে থাকা যায় না। এই পানিতে গোসল করলেই শরীর চুলকায়। মাছ মরে ভেসে উঠে।’ কোদালিয়া ঘাটের নৌকার মাঝি বলেন, ‘নদীর পানি এতোটাই দুর্গন্ধ যে পারাপার হওয়া মানুষগুলিকে নাক চেপে নদী পার হতে হয়। দশ বছর আগেও নদীর পানি এতোটা খারাপ ছিলো না। এখন এই নদীর পানি অভিশাপ।’ একই এলাকার কৃষক মফিজুল বলেন, ‘আগে নদীর পানি সেচ কাজে ব্যবহার করতেন। এখন জমিতে সেচ দিলে ফসল মরে যায়।’ মাছ চাষি দেলোয়ার বলেন, ‘আগে নদীতে কাঠা দিয়ে চৈত্র মাসে তিন চার লাখ টাকার মাছ বিক্রি করতাম। এখন কাঠায় মাছ থাকে না। আর যদি ক্রেতা জানে এখানকার মাছ তাহলে কিনতেও চায় না। এখানকার মাছে কোন স্বাদ নেই।’ এ বিষয়ে নাসির গ্লাস কর্তৃপক্ষ কোনো কথা বলতে রাজি হয়নি। মহেড়া পেপার মিল ইটিপি দেখাতে রাজি না হলেও প্রোডাকশন ম্যানেজার গোলাম রব্বানী বলেছেন, ‘তাদের তরল বর্জ্য পরিশোধিত। আর সাউথ ইস্ট টেক্সটাইল মিলের জেনারেল ম্যানেজার, টেকনিক্যাল ডিপার্টমেন্ট, কাজী রাফিউর রহমান মাসুম বলেন- ‘তাদের ইটিপি জৈবিক। জৈবিক বলেই ২৪ ঘন্টাই চালু রাখতে হয়। শুধু সরকার নয়, বিদেশী ক্রেতারাও নিয়মিত পানি পরীক্ষা করে থাকেন। আমারা যে পানি ছাড়ি তা নিরাপদ। আর জৈবিক ইটিপিতে পানির রঙ পরিবর্তন করা যায় না। তারপরেও আমরা যে পানি ছাড়ি তা অনেকটাই স্বচ্ছ। গবেষক দলের প্রধান মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইএসআরএম বিভাগের অধ্যাপক ড. এএসএম সাইফুল্লাহ জানান, ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে জলজ প্রতিবেশ ব্যবস্থার সবগুলো প্যারামিটার অতিমাত্রায় ভারসাম্যহীন। এখনই দূষণ বন্ধ না হলে পানির উৎস পড়বে হুমকিতে। কেবল নদীর পানিই নয় দূষিত হচ্ছে মাটি ও বায়ু। আর এই দূষণ বর্ষায় চলে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত।’ কারখানার বর্জ্যে নদী ও খালের পানি দূষণের অভিযোগ পাওয়ার পর অভিযুক্ত তিন কারখানা পরিদর্শন করে মন্ত্রণালয়ে যে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে তাতে পানি দূষণের কোন দায় পাননি তদন্ত কর্মকর্তা পরিবেশ অধিদপ্তর টাঙ্গাইলের সহকারী পরিচালক সজীবস কুমার ঘোষ। তিনি বলেন, ‘কারখানার আউটলেট ব্যতিত অন্য কোথাও থেকে পানি পরীক্ষা করার কোন সুযোগ নেই। ঢাকা থেকে টিম এসে নিয়মিত আউটলেটের পানি সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা করে মান-মাত্রায় পেলে তাদের আটকানোর কোন সুযোগ থাকে না। কিছুটা নদী দূষণের কথা স্বীকার করে টাঙ্গাইল জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলামা বলেন- ‘নদীর পানি পরীক্ষা করা হয় না। তাই নদীগুলির পানি কি মাত্রায় দূষিত সে বিষয়ে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য নেই। নদী শুধু কলকারখানা বর্জ্যেই যে দূষিত হয় এমন না। মনুষ্য বর্জ্য ও গৃহস্থালি দূষণও এর জন্য দায়ী।’ তিনি আরও বলেন- ‘জনবল সংকটের জন্য নিয়মিত কারখানা পরিদর্শন করা যায় না। আমরা যখন তাদের ওখানে পরিদর্শনে যাই তখন তা অধিকাংশই ঠিকঠাকই পাই। আর না পেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: