বগুড়ার ‘সবজির চারা গ্রাম’, ক্রেতার অভাবে আটকা ৪ কোটি সবজির চারা

প্রকাশিত: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৪:২৭ পিএম

বগুড়ার শেরপুর উপজেলার রানীনগর ও শাহজাহানপুর উপজেলার শাহনগর অনেক দিন আগে থেকেই সবজির চারার গ্রাম নামে পরিচিত। শীতের সবজি চাষের আগে থেকে এ এলাকার নার্সারিগুলোয় জমে ওঠে কর্মচাঞ্চল্যতা। কিন্তু বিগত বছরের চেয়ে এবার ভিন্ন কিছু প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হয়েছে সবজির চারা উৎপদানকারীদের; বিরুপ আবহাওয়া যার একটি। এ ছাড়া বেড়েছে শ্রমিকের মজুরি, সার-বীজের দাম। আগাম সবজির চারাতে ভালো আয় করলেও মূল সময়টায় এসে হতাশায় পড়তে হয়েছে নার্সারি মালিকদের। নার্সারি মালিক সংগঠন বলছে, বন্যার শঙ্কায় অনেক কৃষক চারা ক্রয় করতে আসছেন না। ফলে মাঠে অন্তত ৪ কোটি পিস সবজির চারা বিক্রয়ের অভাবে আটকে রয়েছে। এটি সময় মতো বিক্রি না করতে পারলে লোকসানের মুখে পড়তে পারে চারা ব্যবসায়ীরা। উৎপাদিত বিভিন্ন জাতের বেগুন, মরিচ, টমেটো, ফুলকপি, বাধাকপি চারা ময়মনসিং, তেঁতুলিয়া, ঠাকুরগাও কুড়িগ্রাম, নাটোর, জলঢাকা, নন্দীগ্রাম, শাজাহানপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলার চাষীরা চারা সংগ্রহ করে চাষ করে। শীতকালেই শুধু নয়, সারা বছর সবজির চারার চাহিদার বড় একটি অংশ পূরণ করেন এ উপজেলার চাষিরা।

শাজাহানপুর উপজেলার শাহনগর গ্রাম। ১৯৮৫ সালের দিকে এখানকার বড়পাথার এলাকায় সবজির নার্সারি ব্যবসা শুরু হয়। ভালো আয় হওয়ায় চারা তৈরির নার্সারি ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের খলিশাকান্দী চোপিনগর, খোট্টাপাড়া, দুরুলিয়া, বৃ-কুষ্টিয়াসহ কয়েকটি গ্রামে। কয়েকটি গ্রামজুড়ে গড়ে উঠেছে অন্তত ২৫০ ছোটবড় নার্সারি।এখানে ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বেগুন, পেঁপেসহ মরিচের চারা পাওয়া যায়। তবে সবজির চারা গ্রামের মূল আইটেম মরিচ। হাইব্রিডসহ একাধিক জাতের মরিচের চারা বিক্রয় হয় এখানে। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আগাম শীতকালীন সবজির চারা নিতে দেশের বিভিন্ন জেলার ক্রেতার সমাগম হয় শাহনগরে। এর মধ্যে জামালপুর, ময়মনসিংহের ক্রেতা বেশি। এরপর রয়েছে গাইবান্ধা, রংপুর, নাটোর, টাঙ্গাইল, ঢাকা, সিরাজগঞ্জ। এতে কর্মসংস্থান হয়েছে বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষসহ প্রায় দুই হাজার মানুষের।

সরেজমিনে সকালে গাড়ীদহ মডেল ইউনিয়নের রানীনগর গ্রামের (বীজ রোপন) চাষী শরিফ উদ্দিন মিন্টুর সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, জৈষ্ঠ মাসের শেষের দিকে জমি প্রস্তুতি শুরু করি। আষাঢ় মাসের শুরুতে বৃষ্টি ও রোদ থেকে বাঁচাতে চারা বীজের বেডের ওপর পলিথিনের ছাউনি দিতে হয়েছে। নিজস্ব প্রযুক্তি, পরিচর্যা, সার ও ছত্রাকনাশক প্রয়োগে এ চারা তৈরী করি। এ চারা ৫ মাস পর্যন্ত বিক্রয় হয়। এই ৫ মাসে তিন থেকে চার বার চারা তৈরী করা যায়। আগাম সবজি চাষের চারা তৈরী হয়েছে। শীতে সবজির বাজার দখল করতে আমরা ব্যস্ত সয়ম পার করছি। এখনো মৌসুম শুরু হয়নি। তাই বর্তমানে চারার চাহিদা কম, দামও কম।
শাহিনুর রহমান জানান, লিডার কপি, বিজলি মরিচ ও টমেটোর চারা সংগ্রহ করছি। রোপনের ৬০ দিনের মধ্যে শীতের বাজারে আসবে চাষিদের উৎপাদিত ফুলকপি ও বাঁধা কপি। এরই মধ্যে লাউ, ঝিঙ্গা, মুলা বাজারে উঠতে শুরু করেছে। শিম, টমেটো, বেগুন কিছু দিনের মধ্যেই বাজারে উঠবে বলেও জানান। রানীহাটের চাষি শী শুমহন্ত বলেন, দীর্ঘ ১২ বছর ধরে বিভিন্ন জাতের সবজির চাষাবাদ করছি।

শাহনগরের সবজির চারা তৈরির বিষয়ে আলাপ হয় এখানকার প্রবীন এক নার্সারি মালিক জালাল উদ্দিন প্রামানিকের সঙ্গে। খলিশাকান্দি গ্রামে সাড়ে চার বিঘার ওপর তার নার্সারি। বয়স ১৮ বছর। এর আগে থেকেই জালাল উদ্দিন গাছ নিয়ে শহরে বিক্রি করতেন।

এই নার্সারি মালিক বলেন, প্রায় ৪০ বছর আগে আমজাদ হোসেনের হাত ধরে শাহনগরে সবজির চারা উৎপাদনের উত্থান হয়। আমি নিজেও তার কাছে থেকে চারা সংগ্রহ করে শহরে বিক্রি করেছি। চারা তৈরির বিষয়ে জালাল উদ্দিন জানান, শীতের সবজির জন্য তারা জুলাই মাস থেকে কাজ শুরু করেন। চলে অক্টোবর পর্যন্ত। কিন্তু এবার তাদের ব্যবসায় প্রথম আঘাত হানে খরা। বর্ষার মৌসুমে কোনো বৃষ্টি না হওয়ায় অনেকের সবজির চারা নষ্ট হয়ে গেছে।

এর মধ্যে জালাল উদ্দিনের প্রায় তিন লাখ পিস সবজির চারা নষ্ট হয়। এতে ক্ষতির পরিমাণ তিন লাখ টাকা। পাশাপাশি বাজারে বীজসহ সারের দামও বেড়েছে। এ ছাড়া গতবছরের চেয়ে এবার প্রতি শ্রমিকদের পিছনে ব্যয় করতে হচ্ছে বাড়তি তিন হাজার টাকা। ফলে সামগ্রিকভাবে সব নার্সারি মালিকদের চারা তৈরিতে খরচের হিসাব বড় হয়েছে।

জালাল উদ্দিন বলেন, তারপরেও আগাম সবজিতে ভালো বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এখন বেচাকেনায় ভাটা পড়েছে। মাঠে অনেক সবজির চারা পড়ে আছে। তবে ক্রেতা আসা শুরু করলে আমার ১০ লাখ টাকার চারা বিক্রি সম্ভব।

নার্সারি মালিকরা জানান, বর্তমান প্রতি হাজার পিস মরিচের চারা বিক্রয় হচ্ছে ৩০০ টাকায়। ফুলকপির চারা ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা, পাতাকপি ৭০০ টাকা এবং বেগুন ও টমেটোর চারার দাম ৫০০ টাকা।

তবে মৌসুমের শুরুতে আগাম সবজি হিসেবে মরিচের চারার দাম আরও বেশি ছিল। প্রতি হাজার পিস চারা বিক্রয় হয়েছে ১ হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার টাকায়। কিন্তু চারা বিক্রয়ের মূল সময়ে এসে দাম কমে গেছে। কারণ এখনকার সবচেয়ে বড় ক্রেতা জামালপুরের কৃষকেরা। কিন্তু বন্যার কারণে তারা চারা কিনছেন না। সবজির চারা গ্রামে দেখা দিয়েছে ক্রেতার সংকট।

নার্সারি মালিক সূত্র আরও জানায়, বগুড়ার পশ্চিম অঞ্চল নন্দীগ্রাম, কাহালু, দুপচাঁচিয়া, আদমদীঘি থেকে আগাম জাতের সবজির চারা বেশি ক্রয় করে। শীতকালীন সবজির চারা নিয়ে যান যমুনা নদীর এলাকার কৃষকরা। ক্রেতা সংকটের কারণটি জানান এখানকার আরেক চারা ব্যবসায়ী মাসুদ রানা। তিনি এই মৌসুমে প্রায় ৪০ লাখ পিস চারা বিক্রয় করেছেন। এতে তার আয় অন্তত ২৫ লাখ টাকা। মাসুদ রানা বলেন, নদনদীতে পানি বাড়ছে। এ সময় কৃষকরা ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। বগুড়ার অল্প কিছু কৃষক আসছেন, কিন্তু বাইরের জেলার ক্রেতাদের আনাগোনাও নেই।

মাসুদ আরও বলেন, আমাদের এলাকায় আগাম সবজির চারা দৈনিক প্রায় ১০ লাখ পিস বিক্রি হয়েছে। আর এখন ক্রেতার দেখাই পাওয়া যাচ্ছে না। যাদের এলাকায় পানি ওঠার শঙ্কা নেই, তারাই টুকটাক চারা ক্রয় করছেন। এখানে সবজির চারা ক্রয় করতে আসা কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা হয়। এর মধ্যে বগুড়ার সারিয়াকান্দির চালুয়াবাড়ীর এজাজুল ইসলাম একজন। মরিচের চারা ক্রয় করে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। জানালেন, তিনজন মিলে বিজলী ও সতেরশো জাতের ৬০ হাজার মরিচের চারা ক্রয় করেছেন। প্রতি হাজারের মূল্য ৩০০ টাকা।

জামালপুরের মাদারগঞ্জের এক কৃষক আবু বক্করের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, আমরা প্রতিবছর এখান থেকে মরিচের চারা নিয়ে যাই। জামালপুরের আরও অনেক কৃষকও চারা ক্রয় করেন। কিন্তু এখন যমুনা নদীতে পানি বাড়ছে। এ জন্য এখন চারা কেনার ঝুঁকি নিচ্ছি না। পানি না কমলে অন্য কৃষকরাও আসবে না। এটাই স্বাভাবিক।

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের তরুণ কৃষক মো. শরিফুলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তিনিও এখানকার নিয়মিত ক্রেতা। শরিফুল বলেন, ৫ হাজার পিস মরিচের চারা কিনেছি। আর ১০ শতক জমিতে আবাদের জন্য ৫০০ পিস ফুলকপির চারা নিয়েছি। প্রতি পিস কপির চারার দাম পড়েছে এক টাকা।

এবারের ব্যবসার পরিস্থিতি নিয়ে জানান শাহনগর সবজির চারা নার্সারি মালিক সংগঠনের সভাপতি আমজাদ হোসেন। তিনি জানান, এবার নার্সারি মালিকরা সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খেয়েছে বীজ সংগ্রহে। ভারতে আবহাওয়া খারাপ হওয়ায় মরিচের বীজের উৎপাদন ভালো হয়নি। এ জন্য দাম বেড়ে গেছে। বিজলী জাতের মরিচের বীজের দাম ছিল প্রতি কেজি ৪৮ হাজার টাকা। এবার সেটি নিতে হয়েছে ৭২ হাজার টাকায়। সতেরশো জাতের দাম ছিল প্রতি কেজি ২৮ হাজার টাকা। সেটি কিনতে হয়েছে ৩১ হাজার টাকা। এভাবে সব জাতের বীজের দাম গড়ে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা বেড়েছে।

আমজাদ হোসেন বলেন, খরচ বাড়লেও প্রথম রাউন্ডে মানে আগাম সবজির চারা তৈরিতে নার্সারি মালিকরা বেশ খুশি ছিল। কারণ ক্রেতা ছিল প্রচুর। ওই সময় এখানকার নার্সারিগুলো অন্তত ৫ কোটি টাকা আয় করেছেন।

কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডে মানে মূল শীতের সবজিতে এসে আমরা ধরা খেয়েছি। বন্যার শঙ্কা থেকে কৃষকরা সবজির চারা ক্রয় করার সাহস পাচ্ছেন না। এতে প্রায় ২৫০ নার্সারির অন্তত ৪ কোটি সবজির চারা পড়ে আছে। এই সময় দৈনিক এক লাখ টাকার নিচে বিক্রি হচ্ছে। তাও অল্প কয়েকটি নার্সারিতে।

ব্যবসার এ সংকট আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই। তবে এখনই বন্যার শঙ্কা কেটে গেলে আবার আগের মতো বেচাকেনা শুরু হয়ে যাবে বলে জানান এই নার্সারি মালিক নেতা।

শীতকালী সবজির চাষ নিয়ে বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কর্মকর্তা ফরিদুর রহমান জানান, জেলায় এ বছর প্রায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমিতে আগাম সবজির চাষ হয়েছে। গত বছর একই পরিমাণ জমিতে প্রায় ৫৪ হাজার টন ফসল উৎপাদন হয়। এ ছাড়া গতবার শীতকালীন সবজি আবাদ হয়েছিল প্রায় ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে। এবার সেই সাপেক্ষে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করবে জেলা কৃষি দপ্তর।

শাহনগরের সবজির চারা দেশজুড়ে খ্যাতি রয়েছে। উত্তরবঙ্গসহ দেশের অন্তত ২৬ টি জেলায় সরবরাহ হয়। এর মধ্যে ময়মনসিংহ, জামালপুর, গাইবান্ধা, রংপুর ও নাটোরে কৃষকরা সবচেয়ে বেশি ক্রয় করে। আর এই নার্সারিগুলোকে ঘিরে প্রায় দুই হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়।

এসব কথা জানান শেরপুর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা শারমিন আক্তার ও শাজাহানপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নুরে আলম। তারা বলেন, আবহাওয়ার পরিস্থিতির কারণে সাময়িক সংকট থাকতে পারে। তবে তা দ্রুত কাটিয়ে উঠবে। এই সবজির চারাকে ঘিরে বছরে অন্তত ১০ কোটি টাকা আয় করেন নার্সারি সংশ্লিষ্টরা।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: