দস্যুতা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে ভালো নেই আত্মসমর্পণকারী জলদস্যুরা

প্রকাশিত: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৩:৪৬ পিএম

মাছুম বিল্লাহ, শ্যামনগর (সাতক্ষীরা) থেকে: সুন্দরবন বিশ্ব মানচিত্রে একটি সুপরিচিত নাম। খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলা নিয়ে সুন্দরবনের অবস্থান। এই বিশাল ম্যানগ্রোভ বনে এক সময় রাজত্ব কায়েম করতেন ৩২ টি ছোট-বড় দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন স্বয়ংক্রিয় সদস্য। অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানিতে বেজে উঠতো পুরা সুন্দরবন। মাছ, কাঁকড়া, মধু, গোলপাতাসহ সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কাজের জন্য বৈধভাবে সুন্দরবনে অনুপ্রবেশকারীদের জিম্মি করে হাতিয়ে নিতেন কোটি কোটি টাকা। নির্যাতিত হতো অসংখ্য জেলে বাওয়ালি। সুন্দরবনের শুধু জেলেরা নির্যাতিত হতোনা, জেলেদের পাশাপাশি জলদস্যুরা ও আতঙ্কে থাকতেন অন্য দস্যু বাহিনীর। এই আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেতে চাইতেন সকল জলদস্যু বাহিনী।

সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে একে একে সব গুলো বাহিনীর তাদের ব্যবহৃত অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ সরকারের কাছে জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। যমুনা টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি মহসিনুল হাকিমের অক্লান্ত পরিশ্রমে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) এর সহযোগিতায় অবশেষে সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হয়। ২০১৬ সালের ১০ ই নভেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করেন। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা ব্যক্তিদের খোঁজখবর নিয়ে দেখা যায় দস্যুতা কালীন সময়ের চেয়ে বর্তমানে সুখে থাকলেও শান্তির ছোয়া লাগেনি তাদের জীবনে। কাদের মাষ্টারের কোথায় কিছুটা বোঝা গেল সুন্দরবনের প্রথম আত্মসমর্পণকারী মাস্টার বাহিনীর প্রধান কাদের মাস্টারের সাথে কথার এক পর্যায়ে বলেন,আমি সহ আমার বাহিনীর যতগুলো সদস্য আত্মসমর্পণ করছে বর্তমানে সবাই দিন আনে দিন খায়। কোন রকম ভাবেই ইটের ভাটা ও মানুষের বাড়ি কাজ করে চলছে তারা। বর্তমানে পরিস্থিতিতে না খেয়ে মরার উপক্রম,এরপরে যদি আবার মামলায় হাজিরা দিতে হয় তাহলে মরা ভালো। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কোন প্রকার সহযোগীতা পান কিনা জানতে চাইলে বলেন, চেয়ারম্যান মেম্বাররা কোন সহযোগিতায় করেনা আমাদের।

তিনটা বাচ্চা নিয়ে আমি এখন অসহায় জীবন যাপন করছি। ঘাড়ের উপরে আছে পাঁচটি মামলা প্রতিমাসে দুই থেকে তিনবার হাজিরা দিতে হয় কোর্টে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো একটি মামলাতে যদি সাজা হয়ে যায় তাহলে আমার পরিবার পথে বসে যাবে। সরকার থেকে দেয়া অনুদানের পুরোটাই চলে গেছে উকিল, মহুরি, কোর্ট, যাতায়াত খরচের পিছনে। আমাদের কোন কিছু দরকার নেই যদি আমাদের মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হতো তাহলে আমরা জীবনের মত বেচে যেতাম।

মুকুল বাহিনীর প্রধান মুকুল বলেন, আত্মসমর্পণ করেছি প্রায় সাত বছর হতে যাচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি ছিল আমাদের মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নেবেন,কিন্তু আজ পর্যন্ত তার কোনো সুরাহা হলো না। ৬টা মামলায় আমাকে প্রতি মাসে কয়েক বার কোর্টে যেতে হয়। খরচ হয় অগনিত টাকা এজন্য প্রতি মাসের ঋণে জড়িয়ে যেতে হচ্ছে নিতে হচ্ছে সুদের টাকা। আত্মসমর্পণ করার পর সরকার থেকে টাকা পেয়েছিলাম এক লক্ষ বিশ হাজার টাকাসহ একটি গরু পেয়েছিলাম। কয়েক বার বরিশাল বাগেরহাট যেতে আসতেই শেষ হয়ে গেছে।অপর এক বাহিনী প্রধান ইদ্রিস আলী বলেন, ৫টা মামলা আর পাঁচজন পরিবারের সদস্য নিয়ে বিপাকে পড়ে আছি ৫ জনের মুখে আহার তুলে না দিলেও ৫টা মামলায় হাজিরা দিতে হয়।

শান্ত বাহিনীর প্রধান শান্তর বলেন, ৩টি মামলা নিয়ে বসে আছি প্রতিমাসে যেতে হয় কোর্টে রোজগারের সম্পূর্ণ টাকা কোর্টের খরচেই চলে যায়। আমার বাড়ির পাশে বাজারে আমার একটি দোকান আছে বর্তমান করোনার কারণে দোকানটি বন্ধ আছে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে অসহায় জীবন যাপন করছি। আমার দলের অনেক সদস্য আছে তারা আমার কাছে চিল্লাপাল্লা করে কিন্তু আমি নিজেই অসহায় তাদের আমি কি বলবো। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কোনো সহযোগিতা পান কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন,ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আমাদের কোন সাহায্য সহযোগিতা করে না।১৩নং নিশানবাড়িয়া চেয়ারম্যান বাচ্চু ডিলিয়ার বলেন,আমরা কি ত্রাণ নিয়ে জঙ্গলে যাব,আত্মসমর্পণের কোন খবরই রাখেন না তিনি।

তিনি আরো বলেন, আমার ইউনিয়নের ৪০ হাজার মানুষ ২০ হাজার ভোটার আমি যেটা পাই সেটা একটা ওয়ার্ডের জন্য হলে ভালো হয়।কথার এক পর্যায়ে তিনি জনগণের ওপর দায় চাপিয়ে দেন। মজনু বাহিনীর একজন সদস্য মিলন পাটোয়ারী বলেন, আমরা যে কি খারাপ অবস্থার মধ্যে আছি সেটা বলে বোঝানোর নয়, আমরা পারিনা কোন ভারী কাজ করতে, কারো বাড়িতে কাজ করতে গেলে তারা আমাদের কাজে নেয় না। সরকারি সহযোগিতা পায় কিনা জানতে চাইলে বলেন, র‍্যাব এর মাধ্যমে যে সহযোগিতা পেয়েছি তা ছাড়া অন্য কেউ আমাদের একটা টাকাও সহযোগিতা করে নাই। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য সহযোগিতা আমরা পাইনা।

তার দাবি সরকার যদি আমাদের মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নেন তাহলে আমারা না খেয়ে বাড়ি থাকতে পারবো, কোর্টে হাজিরার জন্য কারো কাছ থেকে টাকা সুদে নিতে হবে না। ইতিমধ্যে অনেক সুদের টাকায় জড়িয়ে পড়েছি, আর পড়তে চাচ্ছি না আমাদের বাঁচান আমাদের মামলাগুলো প্রত্যাহার করেন। আলম বাহিনীর প্রধানের কাছে জানতে চাইলে আলম বলেন, আত্মসমর্পণের পরে ইজিবাইক কিনে কোন রকম দিনপাত করছি। একদিকে মামলার বোঝা অন্যদিকে সংসারের বোঝা নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার কাছে আমাদের আবেদন আপনিতো মানবতার মা আমাদের মামলাগুলো প্রত্যাহার করে দেন মামলার বোঝা থেকে আমাদের বাঁচান। দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা হবে এমনটাই আশা করেন বাহিনীপ্রধান সহ সকল সদস্যরা। মামলার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে র‍্যাব-৬ সাতক্ষীরার কোম্পানি কমান্ডার স্কট অন লিডার ইশতিয়াক হোসেন বিস্তারিত জানেন না বলে জানান।

৩২টি বাহিনী প্রধানসহ সর্বমোট ৩২৮ বনদস্যু আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন। তারা র‌্যাবের হাতে তুলে দিয়েছেন মোট ৪৬২টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৩৩ হাজার ৫০৪ রাউন্ড গোলাবারুদ। এর ফলে দীর্ঘ ৪০ বছর পর গোটা সুন্দরবন এখন বনদস্যুদের শঙ্কা থেকে রেহাই পেয়েছে।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: