ইসি থেকে এনআইডি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিতে আইন প্রস্তুত

প্রকাশিত: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০২:০৯ পিএম

নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে জাতীয় পচিয়পত্র (এনআইডি) স্থান্তর করতে আইন করা হচ্ছে। আইনটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিপরিষদে পাঠাতে সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। এ আইনে নাগরিকত্ব বাতিলের বিধানও রাখা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী দেশে আসলেই মন্ত্রীপরিষদ বৈঠকে এটি অনুমোদন দেয়া হতে পারে।  এর পর আইনটি সংসদে পাঠানো হবে বলে সংশ্লিষ্ঠ সূত্র জানায়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী বলেছেন, সুরক্ষা সেবা বিভাগের অধীনে এনআইডি সেবা পরিচালনার জন্য বিদ্যমান আইনটি সংশোধন করা হবে। আমরা আইনের খসড়াটি এরই মধ্যে প্রস্তুত করে ফেলেছি। আশা করছি এটি দ্রুত মন্ত্রীসভার অনুমোদন দেয়া হবে।

তিনি বলেন, আগের আইনটিই (জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন আইন, ২০১০) মোটামুটি থাকছে। সংশোধিত আইনে এনআইডি সেবাদানকারী সংস্থা হিসেবে ‘নির্বাচন কমিশন’র পরিবর্তে ‘সরকার’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে।

এ বিষয়ে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শফিউল আজিম (আইন ও বিধি অনুবিভাগ) বলেছেন, জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা সুরক্ষা সেবা বিভাগের কাছে হস্তান্তরের জন্য আইন সংশোধন করে নতুন করে প্রণয়ন করা হয়েছে। এ জন্য আইনের খসড়াটি আমাদের এখান থেকে যাচাই করে দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য বিধি-বিধানের সঙ্গে কোথাও কোনো অসঙ্গতি আছে কি না, তা দেখে দেওয়া হয়েছে। এখন এটি মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে।

জানা যায়, বিদ্যমান জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন ২০১০-এর বাতিল সংক্রান্ত ধারায় বলা আছে- কোনো নাগরিকের নাগরিকত্ব অবসান হইলে তাহার জাতীয় পরিচয়পত্র বাতিল বলিয়া গণ্য হইবে এবং উক্ত জাতীয় পরিচয়পত্রে প্রদত্ত জাতীয় পরিচিতি নম্বর অন্য কোনো নাগরিকের বরাবরে প্রদত্ত জাতীয় পরিচয়পত্রে ব্যবহার করা যাইবে না।

নতুন আইনের এই ধারায় আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পাশাপাশি নতুন একটি ধারা যোগ করা হয়েছে। আগের ধারা কিছুটা সংশোধন করে বলা হয়েছে- কোনো নাগরিকের নাগরিকত্ব অবসান হইলে বা তিনি মৃত্যুবরণ করিলে তাহার জাতীয় পরিচয়পত্র বাতিল বলিয়া গণ্য হইবে এবং উক্ত জাতীয় পরিচয়পত্রে প্রদত্ত জাতীয় পরিচিতি নম্বর অন্য কোনো নাগরিকের বরাবরে প্রদত্ত জাতীয় পরিচয়পত্রে ব্যবহার করা যাইবে না। নতুন ধারায় বলা হয়েছে- সরকার প্রয়োজনবোধে যে কোনো ব্যক্তিকে কারণ দর্শাইয়া তার জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বাতিল করতে পারবে।

প্রস্তাবিত আইনে জাতীয় পরিচয়পত্র-সংক্রান্ত বিভিন্ন অপরাধের দন্ড হিসেবে সর্বোচ্চ ৭ বছর এবং সর্বনিম্ন দুই বছর কারাদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্র জাল করলে বা যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া অন্য কারও পরিচয়পত্র বহন, পরিচয়পত্র পাওয়ার ক্ষেত্রে জ্ঞাতসারে মিথ্যা বা বিকৃত বা তথ্য গোপন করলে অনধিক সাত বছরের কারাদন্ড হবে। এ ক্ষেত্রে অর্থদন্ডের কথাও আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কী পরিমাণ অর্থদন্ড হবে, তা উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ অর্থদন্ডের ক্ষেত্রে আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হতে পারে।

একইভাবে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী অথবা এই আইন দ্বারা বা ইহার অধীন জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনা, জাতীয় পরিচয়পত্র প্রস্তুতকরণ, বিতরণ ও রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনরত কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে নিবন্ধকের নিকট সংরক্ষিত জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত বিকৃত বা বিনষ্ট করলে তিনি এই আইনের অধীন অপরাধ করেছেন বলিয়া গণ্য হবে।

উপরোক্ত অপরাধের জন্য তিনি সাত বছর পর্যন্ত কারাদন্ড অথবা অর্থদন্ড অথবা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবেন। পাশাপাশি কেউ অসৎ উদ্দেশ্যে জাতীয় পরিচয়পত্রে উল্লেখিত কোনো তথ্য বিকৃত অথবা বিনষ্ট করলে তিনি এই আইনের অধীন অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবে। এরূপ অপরাধের জন্য তিনি দুই বছরের কারাদন্ড বা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ড দন্ডিত হবেন।

এ ছাড়া এই আইনে অভিযোগ, তদন্ত ও বিচার-আপিল নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ১৮৯৮ সালের সিআরপিসির বিধান প্রযোজ্য হবে। আইনের খসড়া অনুযায়ী, একজন নাগরিককে একটি জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন নম্বর দেওয়া হবে। যেটা স্ব-স্ব নাগরিকের একক নিবন্ধন নম্বর হিসেবে সব জায়গায় ব্যবহার হবে। জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধকের পাঁচটি সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় ‘নিবন্ধককে তথ্য-উপাত্ত ইত্যাদি সরবরাহ ও সহায়তায় বাধ্যবাধকতা’ শীর্ষক একটি ধারায় সব ধরনের প্রতিষ্ঠানকে তথ্য দিতে বাধ্য করার বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘নিবন্ধকের চাহিদা অনুযায়ী যে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কমিশন বা সংস্থা উহাদের নিকট সংরক্ষিত তথ্য, কাগজপত্র ইত্যাদি নিবন্ধককে দিতে এবং দায়িত্ব পালনে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করিতে বাধ্য থাকিবে।

এদিকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) কর্মকর্তরা জানান, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নিবন্ধন কার্যক্রম এবং এসংক্রান্ত সেবার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে যাক, তা তাঁরা চান না। এতে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ ঝুঁকি ও হুমকির মধ্যে পড়বে। এ ছাড়া স্বাধীন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনে জনগণ যেসব ব্যক্তিগত গোপনীয় তথ্য দিয়েছে সেসব অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে হস্তান্তর সংবিধান, আইন ও বিধি পরিপন্থী হবে।

ইসি সূত্র জানায়, ভোটার তালিকা ডাটাবেইজ এবং জাতীয় পরিচয়পত্র ডাটাবেইজের দ্বৈত ব্যবস্থাপনা থাকলে ইভিএম এ ভোট গ্রহণের ক্ষেত্রে অন্য মন্ত্রনালয়/বিভাগের নিয়ন্ত্রাধীন জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে ভোটার সনাক্ত করলে নির্বাচন আইনসিদ্ধ/বিধিসম্মত হবে না। এছাড়াও ডাটাবেইজের দ্বৈত ব্যবস্থাপনার কারনে ইভিএম এ রক্ষিত ভোটার তথ্যও অন্য মন্ত্রনালয়/বিভাগের এনআইডি এর তথ্যে গরমিল পরিলক্ষিত হলে ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় ভোটার সনাক্তকরণ, প্রার্থী ব্যবস্থাপনা, ভোটার ব্যবস্থাপনা এবং নির্বাচন ব্যবস্থাপনা বিঘ্নিত হবে।

বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন বলছে, সংবিধান অনুযায়ী ভোটার তালিকা প্রস্তুত করার দায়িত্ব শুধু ইসির। কমিশনের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ভোটার তালিকা ডাটাবেইস থেকে উপজাত হিসেবে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান করা হয়। জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য আলাদা কোনো ডাটাবেইস নেই। নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এই অভিন্ন ডাটাবেইসের রক্ষণাবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করলে একদিকে যেমন ডাটাবেইসের তথ্যে গরমিল সৃষ্টি হবে, অন্যদিকে ভোটার তালিকার বিশুদ্ধতা, নিরপেক্ষতা নিয়ে রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা ও গোষ্ঠীর মধ্যে প্রশ্ন দেখা দেবে। এর ফলে ২০০৬ সালের মতো সাংবিধানিক সংকটও সৃষ্টি হতে পারে।

প্রসঙ্গত, এনআইডির দায়িত্ব পেতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গত বছরের ১৭ মে এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের দায়িত্বগুলোর মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত এবং জাতীয় পরিচয়পত্র আইন ২০১০ সংশোধন করে ‘নির্বাচন কমিশন’-এর পরিবর্তে ‘সরকার’ শব্দ অন্তর্ভুক্ত করে আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনীর কথা বলা হয়।

নির্বাচন কমিশন ২০০৭-০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ শুরু করে। ভোটার তালিকার সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার কার্যক্রমও পরিচালিত হয় ইসির মাধ্যমে। ২০১০ সালে ইসির অধীনেই এনআইডি নিবন্ধন অনুবিভাগ একটি আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পায়। এনআইডি সেবা কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে দেওয়ার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে শুরু থেকেই ইসি বলছিল, যে কাজটি কমিশন করছে সেটি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে হস্তান্তর হলে নতুন জনবল ও অবকাঠামো প্রয়োজন হবে। এতে খরচ হবে সরকারের কোটি কোটি টাকা। এছাড়া ভোটার আইডি কার্ড করতে গিয়ে কমিশন নাগরিকদের ৩২ ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে। ফলে এনআইডি সেবা কার্যক্রম কমিশনের হাতে থাকাই যুক্তিযুক্ত।

সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে গত বছরের ২৯ মে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা বলেছিলেন, কমিশনের সঙ্গে কোনোরূপ আলাপ-আলোচনা ছাড়াই সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি কমিশনের হাতেই থাকা উচিত। তখন এক ব্রিফিংয়ে তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের প্রতিক্রিয়া ছিল এমন, সরকারের এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ইসির শুধু অঙ্গহানিই হবে না, এর মাধ্যমে কমিশনের কফিনে শেষ পেরেক যুক্ত হবে।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: