উন্মুক্ত কারাগারের ১৬০ একর জমি দখলের মহোৎসব

প্রকাশিত: ১৫ অক্টোবর ২০২২, ১০:০০ এএম

কক্সবাজারের উখিয়ায় প্রস্তাবিত দেশের প্রথম উন্মুক্ত কারাগারের জন্য বন্দোবস্ত পাওয়া ১৬০ একর জমি দখলের মহোৎসব চলছে। কারা অধিদপ্তরের নামে বরাদ্দ পাওয়া খাস খতিয়ানের এসব জমি অবৈধ দখল হস্তান্তর করে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বন বিভাগের স্থানীয় ভিলেজার (বনের উপকারভোগী) নামধারি চক্র। দখল চক্রকে অনৈতিকতায় বন বিভাগের অসাধু কতিপয় কর্মকর্তা সহযোগিতা দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

বরাদ্দ পাওয়া পুরো জমিতে মৎস্য ঘের, অবৈধ বসতি, পানের বরজ, মৌসুমী ফসল চাষ ও খেলার মাঠ করা হয়েছে। বিশাল এ এলাকায় বনজ হাতেগোনা কয়েকটি গাছ ছাড়া বাকি ঝোপঝাড় বৈ কিছুই নেই। এসব কারণেই, দখল ও বিক্রয় বলবৎ রাখতে নানা অপৎপরতা শুরু করেছে অসাধু চক্রটি। উন্মুক্ত কারাগারের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শনে গিয়ে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

সূত্র মতে, লঘু অপরাধে অভিযুক্তদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সম্পদে তৈরি করতে দেশের প্রথম উম্মুক্ত কারাগার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। উখিয়া উপজেলার পাগলির বিল মৌজার ১নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত বিএস ৮০৩ নম্বর দাগের ৩১০ একর জমি দেশের ক্ষুদে অপরাধীদের পুনর্বাসন কার্যক্রম বাস্তবায়নের স্বার্থে বন্দোবস্তের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ প্রেরন করে।

সরকারের সংশ্লিষ্টবিভাগের নির্দেশনা মতে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্নের পর কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন কারা অধিদপ্তরের নামে সংশ্লিষ্ট জমির সমতল ১৬০ একর জমি ভূমি দলিল সম্পাদন করে কক্সবাজার জেলা কারাগারের সুপারকে হস্তান্তর করে। এরপর চলতি বছরের ২৭ মে উখিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও কারা কর্তৃপক্ষের পক্ষের উপস্থিতিতে সীমানা নির্ধারণ করে খুঁটি স্থাপন করা হয়।

কিন্তু গেলো ২৫ জুন কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের দারিয়ারদিঘী এলাকার সহকারি বন সংরক্ষক (এসিএফ) মো. আনিসুর রহমানের নেতৃত্বে ওইসব খুঁটি উপড়ে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সেদিন বনবিভাগের সাথে দখলদার চক্রের লোকজন সাথে থাকায় স্বভাবতয় সমালোচনা চলছে, দখলদারদের স্বার্থ রক্ষায় সরকারি কর্মকর্তা হয়েও এসিএফ আনিস আইন-বহির্ভুতভাবে খুঁটি উপড়ে ফেলেন। বিষয়টি কারা কর্তৃপক্ষ সংশিষ্ট দপ্তরে অবগত করলে সর্বশেষ গত ২৪ জুলাই বন বিভাগের ওই এসিএফ'র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ তথ্য প্রকাশ পাবার পর উন্মুক্ত কারাগারের জন্য নির্ধারিত স্থান পরিদর্শনে দেখা গেছে, এসব জমিতে আমবাগান, চারটি মাছের খামার, পানের বরজ, দখল নিশ্চিত করতে টিনের চালা-বেড়া দিয়ে ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। দখলদারদের ভাষ্য, স্থানীয় ভিলেজারদের কাছ থেকে এসব দখল কিনেছেন তারা। অসাধু বনকর্মীদের সহযোগিতায় ভোগ ও দখল বিক্রি হওয়ায় দখলকারদের বিরুদ্ধে কোন মামলা বা ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ ওঠে।

স্থানীয় সূত্র মতে, কারা অধিদপ্তরের নামে বন্দোবস্ত হওয়া জমিতে সবচেয়ে বড় দখলদার উখিয়ার উত্তর বড়বিল এলাকার মৃত হারু মিয়ার ছেলে মকতুল হোসেন মতু। বনের ভিলেজার হিসেবে পরিচিতির সূত্রে তিনি একাই দখল করেছেন ১২০ একরের মতো জায়গা। দখলের পর এসব জমি বিক্রিও করেছেন চড়া দামে। মহেশখালিরর সালাউদ্দিন, নুরুল হক, সেলিম ও আমিনকে প্রায় একশত একর জমির দখল হস্তান্তর করেছেন। রোহিঙ্গা আমির হামজাকে দিয়েছেন ৩ একর। বড়বিল এলাকার বদিউর রহমানের ছেলে নুরুল আলমকে বিক্রি করেম ৫ একর জমি।

দখলকার মকতুল হোসেন মতুর স্বাক্ষরে হলফনামায় খাস জমি দখল হস্তান্তরের বেশ কয়েকটি বিক্রয় রশিদ প্রতিনিধির হাতে এসেছে। এসব হলফনামায়, নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের নতুন পাড়া এলাকার সোলতান আহমদ গংকে ৭২ শতক, উখিয়ার রতœপালং ইউনিয়নের করইবনিয়া এলাকার ছৈয়দ আহমদের স্ত্রী মাবেলা বেগম ও লেঙ্গুরবিল এলাকার আবুল কাশেমের ছেলে মোহাম্মদ নুরকে ৩ একর ২০ শতক, নাইক্ষ্যংছড়ির রেজু মৌজার বাসিন্দা মো. কালুর ছেলে আবদুল আজিজ গংকে ২ এক ৬ শতক, নাইক্ষ্যংছড়ির সোনাইছড়ি এলাকার নুরুল আলমের স্ত্রী গোলবাহার গংকে ৮ একর ও উত্তর বড়বিল এলাকার নুরুল আলমের ছেলে জাহাঙ্গীর আলম গংকে ২ একর ৪০ শতক জমি বিক্রি করে কোটি টাকা হাতিয়ে নেন মতুর দখলবাজ চক্র।

এছাড়াও, বনের ভিলেজার পরিচয় থাকা মতু আরো বিভিন্ন জনের কাছে সরকারি খাস জমি বিক্রি করে দখল দিয়েছেন। তবে, দখল বিক্রির বিষয়টি অস্বীকার করে অভিযুক্ত মকতুল হোসেন মতু মুঠোফোনে বলেন, ‘মরহুম বাবা বনবিভাগের হেডম্যান ছিলেন। সেই সুবাদে আমি বনের ভিলেজার হিসেবে বনের প্রয়োজনে কাজ করে দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এসব জায়গা ভোগ দখলে আছি। সমতল জমিতে আমার আম বাগান, একাধিক মাছের ঘের রয়েছে। শুনেছি এসব জমি উন্মুক্ত কারাগারের জন্য কারা অধিদপ্তরের জন্য বরাদ্দ হয়েছে। ১৯৩৫ সনে বনের নামে থাকা জমি বিএস ১ নম্বর খাস খতিয়ানে আসায় রেকর্ড সংশোধনে বনবিভাগ মামলা করেছে বলে জেনেছি। এরপরও সরকার চাইলে যেকোন সময় এ জমি ছেড়ে দিতে প্রস্তুত আছি।’

বন বিভাগের স্থানীয় পাগলিরবিল বিট কর্মকর্তা মো. আফসার হোসেন বলেন, ‘আমি এ বিটে যোগ দেওয়ার অনেক আগেই এসব জমি দখল হয়েছে।’ দখলবাজ চক্রের বিরুদ্ধে কোন মামলা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে, মামলার রেজিস্টার দেখেই বিস্তারিত জানাবেন বলে আর সাড়া দেননি বন কর্মকর্তা মো. আফসার হোসেন।

কক্সবাজার জেলা কারাগারের তত্বাবধায়ক (সুপার) মো. শাহ আলম খান বলেন, ‘কারা কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় বৃহৎ উন্মুক্ত এলাকায় ক্ষুদে অপরাধীদের বৃক্ষরোপণ, অর্গানিক ফলমূল ও সবজি চাষ , মৎস চাষ ও পোল্ট্রি ফার্ম ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং পুনর্বাসনের লক্ষ্যে মালয়েশিয়ার সিআরপির আদলে উক্ত স্থানে উন্মুক্ত কারাগার নির্মানে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। এর ফলে উক্ত এলাকায় ভবিষ্যতে নতুন ভাবে বনায়ন সৃষ্টিসহ ব্যাপকহারে মৎস চাষ, পশু ও হাঁস মুরগী পালনের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং প্রাকৃতিক ভাবেও বিভিন্ন প্রানীর বসবাসের অভয়ারণ্য হয়ে উঠবে। এসব কারণেই উন্মুক্ত কারাগারে বন ও পরিবেশের ক্ষতির কোন আশংকা নেই বরং তা বন ও পরিবেশের উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন কারা কর্তৃপক্ষ।’

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) সারওয়ার আলম বলেন, ‘বিএস জরিপে রক্ষিত বন ঘোষণার প্রতিফলন দেখা না গেলেও ১৯৩৫ সনের গেজেট নোটিফিকেশন কার্যকর ও বলবৎ থাকবে বলে প্রচার আছে। গেজেট বিজ্ঞপ্তি কখনো তামাদি হতে পারে না। রক্ষিত বনভূমি বন্দোবস্ত প্রদান বা গ্রহণের এখতিয়ার কারো নেই। বন আইনের বিধান অনুসারে মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে গেজেট বিজ্ঞপ্তি মূলে ঘোষিত রক্ষিত বনভূমি গেজেট বিজ্ঞপ্তি মূলে বাদ না দেয়া পর্যন্ত তা বনভূমি হিসেবে বহাল থাকবে। তাই যেহেতু গেজেট মূলে আমরা পাহারাদার সেহেতু নিয়ম মতে জমি হস্তান্তর হলে আমাদের উচ্চবাচ্য করার সুযোগ ও প্রয়োজন কোনটাই থাকে না। জেলা প্রশাসন কারা কর্তৃপক্ষকে জমিটি বুঝিয়ে দিয়েছে বলে প্রচার করা হলেও সেদিন আমাদের ডাকা হয়নি। যতক্ষণ নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় হস্তান্তর হয় না, ততক্ষণ জমিটি রক্ষায় আমাদের ততপরতা চালানো দায়িত্বে পড়ে।’

তিনি আরও বলেন, ‘উন্মুক্ত কারাগারের জন্য বরাদ্দ করা জায়গাতে অবৈধ স্থাপনার কথা শুনেছি। অবৈধ দখলবাজদের উচ্ছেদে জেলা প্রশাসনকে আবেদন করা হবে। তবে- এসব জমি তার কর্মকালে দখল হয়নি বলে দাবি করেন ডিএফও।’

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. মামুনুর রশীদ বলেন, ‘উন্মুক্ত কারাগার তৈরির সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসনের নামীয় ১৬০ একর জমি হস্তান্তর করা হয়েছে। কোন্ কারণে বন কর্মকর্তা খুঁটি উপড়ে ফেললেন তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যথাযথ ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হলে নির্দেশনা মতো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: