শেরপুরের সীমান্তঘেঁষা মানুষের পানি সংকট দুর করেছে অটোকল

প্রকাশিত: ১২ নভেম্বর ২০২২, ০৪:১০ পিএম

শেরপুর জেলার সীমান্ত এলাকা পাহাড় বেষ্টিত হওয়ায় সুপেয় পানির সংকট লেগেই থাকে সারা বছর। তবে শ্রীবরদী উপজেলার সীমান্তঘেঁষা চারটি গ্রামের মানুষ সামান্য টাকা খরচ করে জ্বালানি ছাড়াই ২৪ ঘণ্টা অনবরত পাচ্ছেন অটোকলের সুপেয় পানি। নিত্যদিনের সাংসারিক কাজ এমনকি কৃষি কাজেও ব্যবহার করা হয় এই পানি।

অটোকল (টিউবওয়েল লাইন) বদলে দিয়েছে ওই চার গ্রামের মানুষের ভাগ্য। এই অটোকলের কারণে ওইসব গ্রামের শত শত কৃষকের বোরো-আমন আবাদ ও সবজিসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে পানির জন্য হাহাকার করতে হয় না। বিদ্যুৎ ও তেলচালিত সেচের জন্য বসেও থাকতে হয় না তাদের। অটোকলের প্রাকৃতিক পানির সেচ দিয়েই চলছে ওই চার গ্রামের প্রায় ১ হাজার একরের বিভিন্ন ফসলের মাঠ।

ফলে বছরে কয়েক কোটি টাকার সেচ খরচ থেকেও বেঁচে গেছে ওইসব গ্রামের মানুষ। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এই পানির সুষ্ঠু ব্যবহার করে আশপাশের অনাবাদি আরও হাজার হাজার একর জমিতে বোরো-আমনসহ বিভিন্ন ফসলের মাঠ সবুজ হয়ে উঠতে পারে বলে স্থানীয় গ্রামবাসী, আদিবাসী নেতা এবং কৃষি বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

জেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার উত্তরে কাকিলাকূড়া ইউনিয়নের ভারতের মেঘালয় রাজ্য সীমান্তঘেঁষা বিদ্যুৎ ও রাস্তাঘাটবিহীন পাহাড়ি প্রত্যন্ত রাঙ্গাজান, বালিজুরি, খ্রিস্টান পাড়া ও অফিস পাড়া গ্রাম। গ্রামগুলোতে ৫ থেকে ৬ হাজার লোকের বসবাস। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ কৃষি কাজের ওপর নির্ভরশীল। ওই চার গ্রামের পাশ দিয়েই অর্ধবৃত্তাকারে বয়ে গেছে ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি সোমেশ্বরী নদী। ওই নদিতে এক সময় চৈত্র মাসেও পানি থাকতো। প্রায় এক যুগ আগেও ওই পানি দিয়েই ওই চার গ্রামসহ আশপাশের আরও অনেক গ্রামের মানুষ
বোরো-আমন আবাদ এবং অন্যান্য মওসুমের সবজি আবাদসহ বিভিন্ন ফসল চাষাবাদ করতো।

এক সময় নদীর পানি শুকিয়ে যায়। চাষাবাদের পরিমাণও কমতে শুরু করে গ্রামগুলোতে। প্রায় এক যুগ আগে প্রথমে রাঙ্গাজান গ্রামের মানুষ খাবার পানির জন্য টিউবওয়েল বোরিং করতে গিয়ে দেখল ৬০ থেকে ৮০ ফুট বোরিং করার পর ওই বোরিং বা খাদ বা গর্ত থেকে অনবরত পানি উঠতে থাকে। গ্রামবাসী তখন এটা আল্লাহর দান ভেবে টিউবওয়েলের মাথা বা চাপকল না বসিয়েই সেই পানি পান এবং গোসল করাসহ বিভিন্ন গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করা শুরু করে।

আস্তে আস্তে আশপাশের অফিস পাড়া, খ্রিস্টান পাড়া ও বালিজুরি গ্রামের মানুষও ১.৫ ইঞ্চি পাইপ দিয়ে প্রায় ৬০ থেকে ৮০ ফুট পাইপ বোরিং করে ওই পানি ব্যবহার করতে শুরু করলেন। স্থানীয়ভাবে ওই পানির লাইনের নাম হয়ে যায় ‘অটোকল’। তবে গ্রামের অনেকই এটাকে জাদুর কল বলেও অভিহিত করে থাকেন। আবার গ্রামের কেউ কেউ এই পানি আল্লাহর দান ভেবে ব্যবহার করে আসছেন। একপর্যায় বছরজুড়ে ওই পানির প্রবাহ একই রকম থাকায় গ্রামবাসী তাদের বাড়ির আশপাশের

পতিত জমিতে প্রথমে সবজি এবং পরে বোরোসহ বিভিন্ন ফসল ফলাতে থাকেন। গত প্রায় ১০ বছরে ওই চার গ্রামের কয়েকশ মানুষ অটোকলের সুবিধা ভোগ করে আসছেন। বর্তমানে গ্রামের প্রায় ৬০ ভাগ বাড়ি ও ফসলের মাঠের পাশে ওই অটোকল বসানো হয়েছে। ধান কাটার সময় হলে ওই পানির ধারা ড্রেন কেটে পার্শ্ববর্তী নদী ও ঝোড়া বা খালের সঙ্গে সংযোগ করে দেয়া হয়। প্রতিটি অটোকল বসাতে গভীরতা ভেদে শুধু মিস্ত্রি খরচ বাবদ ২ থেকে ৩ হাজার টাকা খরচ হয় বলে জানালেন গ্রামবাসী। কারণ পাইপ দিয়ে বোরিং করার পর ওই পাইপ তুলে ফেলে কেবল কয়েক হাত বাঁশের এবং প্লাস্টিকের পাইপ বসিয়ে দিলেই পানি উঠতে থাকে। তবে খাবারের জন্য বসানো বাড়ির কলগুলোতে একটি করে ফিল্টার বসানো হয়েছে এবং আর্সেনিক পরীক্ষাও করা হয়েছে বলে জালালেন গ্রামবাসী। খাবারের জন্য ওই পানি খুবই সুপেয় এবং সব সময় ফ্রিজের পানির মতো ঠান্ডা থাকে।

উপকারভোগী কয়েকজন গ্রামবাসী জানান, বর্তমানে ওই চার গ্রামের প্রায় ১ হাজার একর জমিতে বোরো আবাদ করা হচ্ছে। এতে তাদের কেবল সার ও কীটনাশক ছাড়া আর কোনো খরচ হয় না। তবে এলাকার সচেতন আদিবাসী নেতা ও কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানান, ওই পানির সুষ্ঠু ব্যবহার করে বিশেষ করে বছরজুড়ে যে পরিমাণ পানি অপচয় হয় ওই অপচয়কৃত পানি কাজে লাগিয়ে আশপাশের অন্যান্য গ্রামে যেখানে অটোকল নেই সেসব গ্রামে এবং পাহাড়ের ওইসব জমির চেয়ে একটু উঁচু জমিতে পানির ক্যানেল বা খাল খনন করে পানি জমিয়ে পরে দেশীয় পদ্ধতি সেচের মাধ্যমে আরও প্রায় কয়েক হাজার একর জমিতে বোরাসহ বিভিন্ন ফসল ফলানো সম্ভব। তবে এতে সরকারের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। ইতোমধ্যে একটি এনজিওর খ্রিষ্টান পাড়ায় অটোকলের পানি জমিয়ে রাখতে বেশ কয়েকটি চৌবাচ্চা বা ট্যাংক তৈরি করে দিয়েছে। এতে পানি জমিয়ে রেখে পরে ওই পানি তাদের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবে।

কৃষি বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় যদি ওই এলাকায় কোনো প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে অপচয়কৃত পানি এবং আরও বেশি করে বোরিং করে পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানি নিয়ে আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে পানি সরবরাহ করা যায় তবে আরও অধিত জমিতে অল্প খরচে অধিক ফসল ফলানো যাবে। তাতে সীমান্তবর্তী ওই সব হতদরিদ্র মানুষ একদিকে যেমন কম খরচে এবং কম পরিশ্রমে অধিক ফসল ফলাতে সক্ষম হবে, অপরদিকে তাদের ভাগ্যেরও আরও পরিবর্তন হবে বলে মনে করছেন এলাকাবাসী।

হারিয়াকোনা গ্রামের আদিবাসী নেতা প্রাঞ্জল এম সাংমা বলেন, প্রায় দুই যুগ আগেও আমাদের এই পাহাড়ি এলাকায় অনেক ঝোড়া বা ঝর্ণা ছিল। সে ঝর্ণা দিয়ে বছরের সব সময় পানি প্রবাহিত হয়ে পাশের সোমেশ্বরী নদীতে বয়ে যেত। কিন্তু এখন তা স্বপ্নের মতো মনে হয়। সেই ঝর্ণাও নেই। নদীতে পানিও নেই।

গত প্রায় ২০ বছর ধরে চৈত্র মাস আসার আগেই ওই নদীর পানি শুকিয়ে যায়। ফলে আমরা প্রায় ২০ বছর আগে পানির সমস্যার কারণে কোনো ফসল ফলাতে পারিনি। গত ৮ থেকে ১০ বছর ধরে এই অটোকলের সাহায্যে আমরা আবার আবাদ-ফসল ফলাতে পারছি। তবে সরকারিভাবে এই পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করলে আশপাশের আরও অনেক গ্রামের মানুষ উপকার পাবে।

জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গছে, শ্রীবরদী উপজেলায় প্রায় ২০ হাজার হেক্টর ফসলের জমি রয়েছে। এসব জমিতে উফশী, বোরো, আমনসহ বিভিন্ন সবজির আবাদ করা হয়।

জনস্বাস্থ্য বিভাগের শ্রীবরদী উপজেলার প্রকৌশলী মনিরুজ্জামান বলেন, আসলে এই ধরনের পানির লেয়ার পাহাড়ের পাদদেশে অনেক সময় বের হয়, সেটা আসলে স্প্রিং লেয়ার। এটাকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে সংরক্ষণ করে ওই জনপদের মধ্যে সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এই বিষয়টি আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবো।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: