উপকূলবাসীর আতঙ্কের নাম ‘নভেম্বর মাস’

প্রকাশিত: ১৫ নভেম্বর ২০২২, ১১:৩২ এএম

আজ সেই ভয়াল ১৫ নভেম্বর। দুঃসহ স্মৃতি বিজড়িত সিডর দিবস। ২০০৭ সালের এই দিনে সুপার সাইক্লোন আঘাত হানে উপকূলীয় এলাকায়। লণ্ডভণ্ড করে দেয় প্রকৃতি ও মানবতাকে। ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা, বরগুনা, পাথরঘাটা সহ বেশ কয়েকটি উপজেলা। এ ভয়াবহ স্মৃতি আর বেদনায় প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে জড়িয়ে আছে।

সিডরের ১৪ বছর পেরিয়ে গেলেও এ স্মৃতি যেন আজও উপকূলের মানুষের মনে ভয়াবহতা বয়ে বেড়াচ্ছে। সিডরের অগ্নি মূর্তির কথা মনে করে অনেকে এখনো আঁতকে উঠে নিজের অজান্তে দক্ষিণাঞ্চলবাসী।

উপকূলের মানুষের স্মৃতিতে আজো ভেসে ওঠে শত শত মানুষের চিৎকার আর স্বজনদের বাঁচর আকুতি। সরকারী তথ্যনুসারে, ১৯৬০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৩৬টি বড় ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের হদিস পাওয়া যায়। এরমধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক পাঁচটি ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে অন্যতম সিডর। বাংলাদেশে সিডরের আগে যে ভয়ানক ঘূর্ণিঝড়গুলো আঘাত করেছিল, সেগুলোর কোনো নাম ছিল না। এর আগের বড় ঘূর্ণিঝড়গুলোকে ‘সিভিয়ার সাইক্লোনিক স্টর্ম’ বা প্রবল ঘূর্ণিঝড় হিসেবে উল্লেখ করা হতো। এ অঞ্চলে যে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানবে তার নাম দেওয়া শুরু হয় ২০০৪ সাল থেকে।

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে ভরা জোয়ারে ভড় করে বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় পৌনে তিনশ’ কিলোমিটার বেগে ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ বলেশ্বর নদী মোহনা হয়ে উপকূলের ১০টি জেলার জনপদে হামলে পরে। পর্যাপ্ত প্রাক-সতর্কতার কারণে ইতিহাসের ভয়াবহতম ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানীর সংখ্যা যথেষ্ঠ হ্রাস করা সম্ভব হলেও সম্পদের ক্ষতি ছিল কল্পনাতীত। ঘূর্ণিঝড় সিডরে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয় উপকূলের ১০টি জেলায়। যার সিংহভাগই ছিল পটুয়াখালী, বরগুনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠী ও বরিশালে।

তবে বেসরকারী সূত্রের মতে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ছিল প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। আর প্রাণহানী ঘটেছিলো তিন হাজার মানুষের। নিখোঁজ ছিলো আরো সহস্রাধীক। পরবর্তীতে নিখোঁজদের আর কোন সন্ধান মেলেনি। ইতিহাসের এক ভয়াবহ বিপর্যয় ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’র রাতে সাগরপাাড়ের হরিণঘাটা-পাথরঘাটা থেকে প্রায় আড়াইশ কিলোমিটার দুরের বরিশাল পর্যন্ত একইসাথে প্রায় সমান বেগে সিডরের নারকীয় তান্ডব অব্যাহত ছিল। এমনকি বরিশাল মহানগরীতেও ঘূর্ণিঝড় সিডরের তীব্রতা ছিল সোয়া দুই'শ কিলোমিটার।

১৫ নভেম্বর সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত বাগেরহটের মোড়েলগঞ্জ, শরনখোলা, রামপাল থেকে পিরোজপুর, ঝালকাঠী ও বরিশাল হয়ে মাদারীপুর, শরিয়তপুর এবং গোপালগঞ্জ পর্যন্ত সিডরের তান্ডব অব্যাহত ছিল। একইভাবে ঝড়টি পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার পশ্চিমভাগেও আঘাত হানে। প্রায় পৌনে তিন'শ কিলোমিটার বেগের ওই ঝড়ের সাথে প্রায় ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছাস উপকূলের বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী ও পিরোজপুরের বিশাল জনপদসহ ফসলি জমিকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছিলো।

সরকারী হিসেব মতে, ১৫ নভেম্বর সিডরের তান্ডবে দক্ষিণ উপকূলের বিশাল জনপদের প্রায় চার লাখ ঘরবাড়ী সম্পূর্ণ ও প্রায় ১০ লাখ আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তিন হাজার ১৯৯ জনের মৃত্যু ও ১ হাজার ৭২৬ জন নিখোঁজ হবার কথা বলা হলেও বেসরকারী হিসেবে এসংখ্যাও আরো অনেক বেশী। ধারনা করা হচ্ছে-নিখোঁজ ব্যক্তিদের সিডরে বয়ে আনা জলোচ্ছাস সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরের সেই ধ্বংসলীলা এখনো গোটা উপকূলবাসীকে তারা করে ফিরছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়ালতম প্রাকৃতিক ধ্বংসলীলা ঘটে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর। ওইদিন সিডর নামের ঘূর্ণিঝড়ে সরকারীভাবে তিন হাজার ১৯৯ জনের মৃত্যু ও এক হাজার ৭২৬ জনের নিখোঁজ হওয়ার কথা জানানো হলেও বেসরকারী হিসেবে সিডরে ১০ হাজার মানুষ মারা গেছে। এরপর ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা, ২০১৩ সালের মে মাসের শুরুর দিকে ঘূর্ণিঝড় মহাসেন, ২০১৬ সালের ২১ মে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু, ২০১৭ সালের ৩০ মে ঘূর্ণিঝড় মোরা, ২০১৮ সালের ১১ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় তিতলি, ২০১৯ সালের ৩ মে ঘূর্ণিঝড় ফণী, একই বছরের ৯ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় বুলবুল, ২০২০ সালের ২০ মে সুপার ঘুর্ণিঝড় আম্পান, সবশেষ চলতি বছরের অক্টোবর মাসের ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে গোটা দেশের সাথে দক্ষিণাঞ্চলেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেছে।

নভেম্বর মানেই আতঙ্ক:- ১৭৯৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ওপর শুধু নভেম্বর মাসেই ১১টি মারাত্মক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। যার ফলে ব্যাপক প্রাণহানি, গৃহপালিত ও বন্য পশুর মৃত্যুর পাশাপাশি সম্পদহানীর ঘটনা ঘটেছে। তাই উপকূলবাসীর মধ্যে নভেম্বর মাস আলাদা একটি আতঙ্কের মাস।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: