মোজায় কাগজ-ভরা ফুটবল থেকে তিনটি বিশ্বকাপ জয়

প্রকাশিত: ৩০ ডিসেম্বর ২০২২, ১০:১৫ এএম

নামের পাশে তিনটি বিশ্বকাপ। সেই সঙ্গে একের পর এক ট্রফি, সম্মান এবং অগণিত স্মৃতি। পেলের প্রয়াণে শুধু ফুটবলের একটা যুগেরই শেষ হল না, পেলে বনাম ম্যারাদোনার চিরাচরিত সেই লড়াইয়েরও অবসান হল। ২০২০-র নভেম্বরে কোভিড মহামারির মাঝেই চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছিলেন ম্যারাদোনা। তাঁর অকালপ্রয়াণ মেনে নিতে পারেনি বিশ্ব। পেলেও চলে গেলেন ৮২ বছর বয়সে।

দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। হাসপাতালে ভর্তি করানো লেগেই থাকত। অবশেষে জীবনের শেষ লড়াইয়ে হার মানতে বাধ্য হলেন ‘কালো হিরে’। কথিত আছে, ব্রাজিলের ছেলেরা নাকি জন্মের পরেই প্রথম উপহার হিসেবে পায় একটি ফুটবল। অনেকের সারা জীবন সেই গোলাকার চামড়ার বস্তুটিকে নিয়েই কেটে যায়। অনেকে আবার বড় হওয়ার পর আগ্রহ খুঁজে পায় অন্য কিছুতে। পেলের জীবনও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ব্রাজিলের মিনাস জেরাইসে জন্ম হয়েছিল তাঁর। বাবা ছিলেন ব্রাজিলের ক্লাব ফ্লুমিনেন্সের ফুটবলার ডোনডিনহো। ইলেকট্রিক বাল্বের আবিষ্কর্তা টমাস এডিসনের নামানুসারে ছেলের নাম রাখেন। তবে ‘এডিসন’ বদলে নাম দেন ‘এডসন’। এডসন আরান্তেস দি নাসিমেন্তো। ডাকনাম দেওয়া হয় ‘ডিকো’।

বাবা ফুটবলার হলেও পেলের ছোটবেলা কেটেছে চরম দারিদ্রের মধ্যে। তখনকার দিনে ফুটবলাররা সে রকম বেতন পেতেন না। ফলে সংসার চালানোর জন্য যথেষ্ট রোজগার করা তাঁর বাবার পক্ষে সম্ভব ছিল না। বাবার দেখাদেখি ফুটবলের প্রতি ছোট থেকেই ঝোঁক। পড়াশোনা বিশেষ এগোয়নি। চায়ের দোকানে কাজ করে হাতখরচ জোগাড় করতেন। বাকি যে সময় পেতেন, রাস্তাতেই ফুটবল খেলা চলত। তবে চামড়ার ফুটবল দিয়ে নয়, এ ‘ফুটবল’ অন্য রকম। মোজার ভিতরে কাগজ পুরে তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে সেটা নিয়েই লাথালাথি চলত।

বয়স কিছুটা বাড়ার পর আসল ফুটবলে লাথি মারার সুযোগ পেয়েছিলেন পেলে। স্থানীয় বাউরু এলাকার বিভিন্ন অপেশাদার লিগে খেপ খেলেছেন ছোটবেলায়। গোল করা এবং বল ড্রিবলিং করার ক্ষমতা যেন ঈশ্বরপ্রদত্ত। পেলের ছোটবেলায় ব্রাজিলে ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছিল ‘ফুটসল’ (ইন্ডোর ফুটবল)। ছোটবেলায় চুটিয়ে সেই খেলাই খেলেছেন পেলে। বড় হয়ে স্বীকার করেছেন, ছোট জায়গায় কাটানোর ক্ষমতা এবং দুরূহ কোণ থেকে গোল করার পিছনে ছিল ছোটবেলায় ‘ফুটসল’ খেলা।

সেখান থেকেই ওয়ালদেমার দে ব্রিটোর নজরে পড়ে যান। ব্রিটোই তাঁকে নিয়ে যান ব্রাজিলের ঐতিহ্যশালী ক্লাব স্যান্টোসে। পেলেকে নিয়ে ব্রিটো এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, স্যান্টোসের কর্তাদের সরাসরি বলে দেন, ‘এই ছেলে একদিন বিশ্বের সেরা ফুটবলার হবে’। স্যান্টোসের কোচ লুলাও পেলের খেলা দেখে মুগ্ধ হন। ১৯৫৬-র জুনে প্রথম পেশাদার চুক্তি সই করেন পেলে। পরের মৌসুমেই প্রথম দলে খেলার সুযোগ পান এবং লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। তত দিনে ব্রাজিলে হইচই পড়ে গিয়েছে তাঁকে নিয়ে। পেশাদার ক্লাবে সই করার ১০ মাসের মধ্যে জাতীয় দলে সুযোগ পান।

১৯৫৮-র বিশ্বকাপের শুরুটা খুব একটা ভাল হয়নি পেলের। হাঁটুর চোট নিয়েই তিনি সুইডেনে খেলতে এসেছিলেন। প্রথম ম্যাচ খেলেন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। সেই ম্যাচে একটি ‘অ্যাসিস্ট’ও করেন। সেই সময়ে সব থেকে কম বয়সে বিশ্বকাপে খেলার নজির গড়েন পেলে। সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করেন পেলে। সেটাও সব থেকে কম বয়সে। ফাইনালে সুইডেনের বিরুদ্ধে জোড়া গোল পেলেকে ব্রাজিলের অন্যতম সেরা ফুটবলারের আসনে প্রতিষ্ঠিত করে।

১৯৬২ বিশ্বকাপে তিনি গিয়েছিলেন বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার হিসেবে। ততদিনে দলে গ্যারিঞ্চা, গিলমারের মতো তারকা ফুটবলারও চলে এসেছেন। তবে পূর্বতন চেকোশ্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে দূরপাল্লার একটি শট মারতে গিয়ে চোট পান। বিশ্বকাপ থেকেই ছিটকে যান। গ্যারিঞ্চার সৌজন্যে সেই বিশ্বকাপ ঘরে তোলে ব্রাজিল।

১৯৬৬ বিশ্বকাপ সব থেকে খারাপ যায় ব্রাজিলের কাছে। প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নেয় সেলেকাওরা। পেলেকে যেন সেই বিশ্বকাপের প্রতিপক্ষের ফুটবলাররা মারবেন বলেই ঠিক করে নিয়েছিলেন। প্রথম ম্যাচে বুলগেরিয়ার খেলোয়াড়রা পেলেকে প্রচুর ফাউল করেন। তবে আসল ঘটনা ঘটে পর্তুগালের বিরুদ্ধে। জোয়াও মোরাইস জঘন্য ফাউল করলেও রেফারি তাঁকে লাল কার্ড দেখাননি। সেই সিদ্ধান্ত এখনও পর্যন্ত বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে ‘অন্যতম জঘন্য’ সিদ্ধান্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। পেলে ওই ম্যাচের পরেই পণ করেছিলেন, আর বিশ্বকাপে খেলবেন না। তবে সতীর্থদের অনুরোধে পরে সিদ্ধান্ত বদলান।

১৯৭০ বিশ্বকাপ ছিল পেলের জীবনে শেষ এবং অন্যতম সেরা বিশ্বকাপ। ব্রাজিল দলে তখন তারকার ছড়াছড়ি। ছিলেন রিভেলিনো, টোস্টায়ো, জর্জিনহো, গার্সন, কার্লোস অ্যালবার্তো তোরেসরা। ফাইনালে ইটালিকে ৪-১ ব্যবধানে উড়িয়ে দেয় ব্রাজিল। কার্লোস আলবার্তোকে দেওয়া পেলের সেই পাস এখনও ফুটবলপ্রেমীদের চোখে লেগে রয়েছে।পেলেই একমাত্র ফুটবলার যাঁর তিনটে বিশ্বকাপ জয়ের নজির রয়েছে।

রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাস, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড, ইন্টার মিলান-সহ একাধিক ক্লাব টাকার থলি নিয়ে পেলেকে সই করানোর জন্য বসেছিল। কিন্তু ব্রাজিল ছেড়ে অন্য কোথাও খেলতে যাননি পেলে। অর্থকে বরাবরই দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন তিনি। দীর্ঘ ১৮ বছর স্যান্টোসে খেলেছিলেন। ৪৯৩ ম্যাচে করেছিলেন ৫০১টি গোল।

ফুটবল ছাড়ার পর তিনি ইউনেস্কোর ‘গুডউইল অ্যাম্বাসাডর’ হন। বিভিন্ন দেশে গিয়ে ফুটবলের প্রসারে বহু কাজ করেছেন। রাজনীতিতেও একসময় সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। তবে কোনও দিন প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসেননি। শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন বহু বছর ধরে। ২০১৭ সালে হুইলচেয়ারে করে বিশ্বকাপের ড্রয়ে হাজির হয়েছিলেন। তারপরেই বাড়িতে পড়ে গিয়ে গুরুতর চোট পান। মস্কোর বিশ্বকাপে শারীরিক অসুস্থতার কারণে হাজির থাকতে পারেননি। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত নিয়মিত তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে শারীরিক পরীক্ষা করাতে হত। বহুদিন লড়েছিলেন।শেষ পর্যন্ত বয়স এবং অসুস্থতার কাছে হার মানতেই হল তাঁকে। দিয়েগো ম্যারাদোনা চলে গিয়েছিলেন ২০২০-র শেষের দিকে। এ বার পেলেও দুনিয়া ছাড়লেন। শেষ হয়ে গেল যাবতীয় রেষারেষি, তুলনা, বন্দনা। সূত্র: আনন্দবাজার।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: