চেকের মামলায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন খামারিরা

প্রকাশিত: ২৪ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:৪৫ পিএম

করোনার দীর্ঘ প্রভাবে জয়পুরহাটে ব্যাপক লোকসানে পড়ে একের পর এক বন্ধ হওয়া খামারিরা পূঁজি হারিয়ে পথে বসার পাশাপাশি বর্তমানে চেকের মামলায় তাদের পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। অপরদিকে জেলায় পোল্ট্রি শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় লক্ষাধিক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ার আশংকা করছেন। সাড়ে ৯ টাকা করোনার ধাক্কার পাশাপাশি আবার ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপক প্রভাবে খাদ্যের দাম বেশি হওয়া আবার মুরগি, ডিম ও বাচ্চার দাম তুলনামূলক ভাবে কমে যাওয়ায় লোকসানে পড়ে পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছেন জয়পুরহাটের পোল্ট্রি খামারি ও ব্যবসায়ীরা। মুরগী, বাচ্চা এবং হ্যাচিং (ডিম ফোটানো) কোনটিতেই লাভ করতে পারছেন না পোল্ট্রি খামারিরা।

করোনার দীর্ঘ প্রভাব ও খাদ্য দ্রব্যের উর্দ্ধগতির কারনে মাসের পর মাস লোকসানে পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে জেলার ছোট বড় প্রায় সাড়ে ৪ হাজার খামার। তারপরেও উৎপাদন অনুযায়ী বাজার সৃষ্টি না হওয়ায় এবং মুরগি, ডিম ও বাচ্চার দাম না বাড়লেও কয়েক গুন বেড়েছে খাদ্যের দাম যার ফলে পোল্ট্রি শিল্পের এমন অবস্থা অভিযোগ খামারি ও পোল্ট্রি ব্যবসায়ীদের।

জয়পুরহাট সদর উপজেলার চকম্যাম এলাকার নারী উদ্যেক্তা ”আপন পোল্ট্রি ” ফার্মের মালিক পোল্ট্রি খামারি ফরিদা ইয়াছমিন বুলি। এক যুগ আগে ছোট্র পরিসরে গড়ে তোলেন পোল্ট্রি খামার। সেই খামার বর্তমানে ১৩ বিঘা জুড়ে বিস্তার লাভ করে। সেখানে ২৮ হাজার মুরগি থেকে প্রতিদিন গড়ে ২৩ হাজার ডিম উৎপাদন হচ্ছে। বাজারে মুরগির খাদ্যের লাগামহীন উর্দ্ধগতির কারনে একটি ডিম উৎপাদনে সাড়ে ৯ টাকা খরচ পড়লেও বিক্রি করতে হচ্ছে সাড়ে ৮ থেকে ৯ টাকা। ফলে প্রতি পিস ডিমে লোকাসান গুনতে হচ্ছে পঞ্চাশ পয়সা থেকে এক টাকা।

তিনি জানান, বাচ্চা ফোটানোর হ্যাচারিতে একটি মুরগির বাচ্চা উৎপাদনে খরচ হচ্ছে ১৪/১৫ টাকা অথচ সেই বাচ্চা বিক্রি করতে হচ্ছে ৪/৫ টাকায়। সোনালী জাতের একটি মুরগি এক কেজি ওজন করতে ঊৎপাদন খরচ পড়ছে ২শ ৪০ টাকা কিন্তু বাজারে বিক্রি করতে হচ্ছে ১৭০/১৮০ টাকায়। জামালগঞ্জ সরকারি হাঁস মুরগি খামারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পোল্ট্রি শিল্পে দেশে প্রথম স্থানে থাকা জয়পুরহাট জেলায় মুরগির মাংসের চাহিদা মিটিয়ে এই মুরগি পাঠানো হয়ে থাকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এই শিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জয়পুরহাটে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় প্রায় লক্ষাধিক মানুষের।

করোনার দীর্ঘ প্রভাব আবার ইউক্রেন সমস্যার কারনে পোল্ট্রিশিল্প খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলার পাশাপাশি একদিকে চাহিদা না থাকা, অন্য দিকে খাদ্য দ্রব্যের উর্দ্ধগতির কারনে গত ছয় মাস থেকে মাংস ডিম এবং মুরগির বাচ্চা বিক্রি করে চরম লোকসানে পড়েছেন জেলার পোল্ট্রি খামারি ও ব্যবসায়ীরা। লোকসানের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে ছোট বড় মিলে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার খামার। একের পর এক পোল্ট্রি শিল্প বন্ধ হওয়ার কারনে কর্মহীন হয়ে পড়ছেন হাজার হাজার শ্রমিক। সেই সাথে বর্তমানে কর্মরত শ্রমিকরাও রয়েছেন কর্ম হারানোর আতংকে। জেলার পোল্ট্রি খামারিরা লোকসানে পড়ে খামার বন্ধ করেও রেহাই পাচ্ছেন না।

চেকের মামলায় এখন অনেক খামারি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কানুপুরের মনইল গ্রামের শ্রেয়া পোল্ট্রি ফার্মের মালিক কামরুজ্জামান সরদার জুয়েল বলেন, উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার পরেও জমিজমা বিক্রি করে ব্যাংক ঋণ নিয়ে ৫টি সেডে ১৮ হাজার মুরগি পালনের খামার করি। করোনার প্রভারের পাশাপাশি খাদ্যদ্রব্যের উর্দ্ধগতির কারনে খামার বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছি বর্তমানে চেকের মামলায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে জানান তিনি। জামালগঞ্জের শেফালী পোল্ট্রি এন্ড প্রাইভেট লিমিটেডের মালিক সাইফুল ইসলাম টুকু আলম জানান, ৮০ হাজার মুরগি পালনের খামার পরিচালনা করে থাকি। এতে ব্যাংক ঋণের পরিমান হচ্ছে ৩০ কোটি টাকা। করোনার দীর্ঘ প্রভাবে ৫০ ভাগ খামার একবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। বড় খামার গুলোও বন্ধ হওয়ার পথে উল্লেখ করে বলেন, পোল্ট্রি শিল্পের জন্য খাদ্যের মধ্যে সোয়াবিন তেল, সোয়াবিন ভূষি ও রাইচব্র্যান্ডের দাম শতভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে।

এ ছাড়াও ভূট্টা, সব রকম ভিটামিন, এনজাইম, মিনারেল, লাইমষ্টোনসহ ২২ প্রকারের সামগ্রীর মূল্য ৫০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেখানে মুরগি, ডিম বা বাচ্চার দাম বাড়েনি আবার বর্তমান বাজার নিম্নমূখি হওয়ার কারনে লোকসানের পরিমান বেড়ে যাচ্ছে। এতে পঁজি হারানো শুধু নয় চেকের মামলা ঘাড়ে ঝুলছে বলেও জানান তিনি। জেলার পোলট্রি খামারিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ যুব উদ্যেক্তার পুরস্কার প্রাপ্ত ক্ষেতলাল উপজেলার তাহেরা মজিদ এগ্রো ইন্ডাষ্ট্রিজের ব্যবস্থপনা পরিচালক আতিকুর রহমান বলেন, করোনা শুরু হওয়ার তিন মাসে লোকসানের পরিমান হচ্ছে ৯৬ লাখ টাকা। নিজস্ব খামারে উৎপাদিত ১ লক্ষ সোনালী মাংসের মুরগী, ১০ হাজার সোনালী ডিমের মুরগী ও ৫০ হাজার ব্রয়লার মুরগী প্রতিষ্ঠানের পিকআপের মাধ্যমে সোনালী মুরগি ঢাকা সহ চাপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে সরবারহ করা হতো। তিনি জানান, ব্যংক ঋণের পরিমান ৫০ লাখ টাকাসহ নিজস্ব পুঁজির পরিমান ছিল প্রায় তিন কোটি টাকা। করোনায় ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় সরকারের প্রণোদনা কর্মসূচীর আওতায় সাড়ে ২২ হাজার টাকা পেয়েছেন বলে জানান।

করোনায় ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় এখন পুঁজি শূন্য অবস্থায় রয়েছি। ফলে করিমপুরের ৬০ হাজার মুরগি উৎপাদনের তিনটি শেড টাকার অভাবে এখনও বন্ধ রয়েছে। কালাই উপজেলার বাদাউচ্চ গ্রামের খামারী কাওসার, কাদিরপুর গ্রামের খামারী আবু সাঈদ ও কয়তাহার গ্রামের খামারী সাইদুল ইসলাম বলেন, করোনায় পুঁজি হারিয়ে খামার বন্ধ থাকায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।

অনেকে বন্ধ খামারের জিনিসিপত্র, হ্যাচিং মেশিনসহ জিনিষপত্র বিক্রির চেষ্টা করে তা পারছেন না। এমনকি লাখ লাখ টাকার মেশিনপত্র বিনা পয়সায় দিতে চাইলেও নিতে চাচ্ছেন না কেউ বলে মন্তব্য করেন পোল্ট্রি ব্যবসায়ী ও ডিম ফোটানো হ্যাচিং মালিক আব্দুল আজিজ মোল্লা। পোল্ট্রি ব্যবসায়ী রওনুকুল ইসলাম টিপু চৌধুরী বলেন, কৃষি নির্ভরশীল এ জেলাতে নাই কোন ভারী শিল্প, পোল্ট্রি শিল্পে সোনালী মুরগিতে জেলার পরিচিতি। সে জন্য জেলার ব্যান্ডিং হচ্ছে সোনালী মুরগি। এটি নানাবিধ সমস্যার কারণে বিলুপ্তির পথে, এই ব্যবসার সাথে জড়িত মালিক শ্রমিকরা এখন হতাশায় দিন পার করছেন। তাই সম্ভাবনাময় এই পোল্ট্রি শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি।

জয়পুরহাট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ড্রাস্ট্রির সভাপতি আহসান কবির এপ্লব বলেন, এক সময় পোল্ট্রি শিল্পে এলাকার মানুষের ভাগ্য বদল হলেও বর্তমানে খাদ্যে দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি মুরগি, ডিম ও বাচ্চার মুল্যে কমে যাওয়ায় পোল্ট্রি শিল্পে ব্যাপক ধস নেমেছে। এতে করে লোকসানে পড়ে খামার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশে মুরগির মাংস ও ডিমের ঘাটতি দেখা দিবে বলে আশংকা করেন তিনি। জেলা ব্র্যান্ডিং হিসেবে স্বীকৃত সোনালী মুরগিকে রক্ষায় জেলার পোল্ট্রি শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের আশু সহযোগিতা কামনা করেন পোল্ট্রি ব্যবসায়ীরা।

জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ মোঃ মাহফুজার রহমান জানান, জয়পুরহাট জেলা পোলট্রি শিল্পে বিশেষ করে সোনালী মুরগি ও ডিম উৎপাদনে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা হিসেবে পরিচিত। এখানে ছোট বড় সোনালী ও ব্রয়লার মুরগির খামার ছিল ১১ হাজার ১২০ টি। আর লেয়ার মুরগির (ডিম পাড়া) খামার ছিল ৩৭০টি। জেলায় প্রতি বছর মাংস উৎপাদন হতো ১ লাখ ২৩ হাজার ২০০ মেট্রিক টন।

জয়পুরহাটের সাড়ে ৯ লাখ জনসংখ্যার মানুষের জন্য মাংসের চাহিদা ৪ হাজার ২০০ মেট্রিক টন। উদ্বৃত্ত মাংসের পরিমান ৮১ হাজার ২০০ মেট্রিক টন। যা জয়পুরহাট জেলার মানুষের চাহিদা মিটিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হতো। জেলায় মুরগির ডিম উৎপাদন হয় প্রতি বছর ৩৮ কোটি ৯ লাখ। আর জেলায় ডিমের চাহিদা ৯ কোটি ৮৮ লাখ। জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় উদ্বৃত্ত মাংশ ও ডিম বিক্রি করতেন খামারীরা। জয়পুরহাট জেলায় বাণিজ্যিক ভাবে সোনালী মুরগির বিপুল সংখ্যক খামার গড়ে উঠায় ওই সব পোলট্রি খামারকে কেন্দ্র করে জেলায় ডিম থেকে সোনালী জাতের বাচ্চা ফুটোনোর হ্যাচারী স্থাপন করা হয় ৬৩টি। ফিড মিল রয়েছে ১২টি।

করোনার দীর্ঘ প্রভাব ও ইউক্রেন সমস্যার কারনে জয়পুরহাটে ৪ হাজার খামার বন্ধ হয়েছে উল্লেখ করে বন্ধ হয়ে যাওয়া খামারের সঠিক সংখ্যা নিরুপনে কাজ চলছে এবং ক্ষতিগ্রস্থ খামারিদের জন্য সরকারের নানামুখি পদক্ষেপের কথা জানান, জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ মোঃ মাহফুজার রহমান। তিনি জানান, এলডিডিপি প্রকল্পের আওতায় জেলায় ১২৯ খামারিকে ১৪ হাজার ৪ শ টি একদিনের মুরগির বাচ্চা প্রদানসহ ২ হাজার ৩৮০টি খাবার পাত্র, ২ হাজার ১৮০টি পানির পাত্র দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও ৮৭টি প্রডিউসার গ্রুপ (প্রতি গ্রুপে ৩০ জন খামারি) কে একদিনের প্রশিক্ষন প্রদান করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: