কক্সবাজারে সড়ক ভাড়া দিয়ে পুলিশের চাঁদাবাজি

প্রকাশিত: ৩০ মে ২০২৩, ০৩:০২ পিএম

কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে অস্থায়ী চেকপোস্ট। কাজ আইনি। তবে বৈধ চেকপোস্ট থাকলেও তারা অন্য কাজে ব্যস্ত। আইনের নামে তারা বেআইনি তৎপরতায় লিপ্ত। গাড়ি আটকে তল্লাশির নামে প্রকারান্তরে চাঁদা আদায় যেন ওদের প্রধান কাজ। জেলার এমন কোনো চেকপোস্ট খুঁজে পাওয়া কঠিন যেখানে কাগজপত্র যাচাইয়ের নামে চাঁদার টাকা তোলা হয় না। এছাড়া অবৈধ গাড়ী (কাগজপত্র নেই) সেগুলো চলে মাসোয়ারা ভিত্তিক। শুধু তাই নয়, মহাসড়কের দুই পাশে গাড়ি পাকিংয়েও দিতে হয় টাকা।

নির্ধারিত স্থানে অনেকটা গোপনে গুঁজে দেয়া হচ্ছে টাকা। পকেটে টাকা পড়লেই গাড়ি ছোটে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। কিছুক্ষণ দাঁড়ালে এমন দৃশ্য হরহামেশাই দেখা যায়। চেকপোস্টের নামে চাঁদার এই উৎসব যেন এক ফ্যাশনে রূপ নিয়েছে।

দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ট্রাক, লরি আটক করে চাঁদা দাবি করে ট্রাফিক পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশের একাধিক বিপথগামী দুর্নীতিবাজ সদস্য। এছাড়া কক্সবাজারের বাইরে থেকে আসা লেগুনা, সিএনজি এমনকি রিকশা থেকেও নিয়মিত চাঁদা আদায় হয়। তাদের দাবিকৃত চাঁদা না দিলেই নানাভাবে হয়রানিসহ গাড়ি আটক করে মামলা ঠুকে দেয়। দেয়া হয় হুমকিও।

জানা গেছে, হাইওয়ে, ট্রাফিক ও থানা পুলিশের সামনে প্রতিদিন শত শত বাসে দিন-রাত পালাক্রমে চলছে চাঁদাবাজি। পেশাদার চাঁদাবাজদের পাশাপাশি এসব চাঁদাবাজ চক্রের নেতৃত্ব দেয় সার্জেন্ট অথবা সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার কর্মকর্তা ছাড়াও স্থানীয় কয়েকজন দালাল। এদের থেকেই আবার চাঁদার নির্ধারিত অংশ ভাগ হয়ে যায় ভিন্ন ভিন্ন মহলে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজার শহরে প্রতিদিন বিভিন্ন জেলার অর্ধশত কোম্পানির গাড়ি প্রবেশ করে। এসব গাড়ি প্রবেশ ও পার্কিংয়ের জন্য বাস মালিকদের কাছ থেকে বিশেষ চুক্তির মাধ্যমে নগদ ও বিকাশে প্রতিমাসে অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ট্রাফিক পুলিশ ও হাইওয়ে থানা পুলিশের বিরুদ্ধে।

জানা যায়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সড়কপথে কক্সবাজারে প্রতিদিন বিভিন্ন কোম্পানির অর্ধশত যাত্রীবাহী বাস প্রবেশ করে। সড়কে বাস যাতায়াতের সময় মামলা ও হয়রানি থেকে বাঁচতে ট্রাফিক পুলিশ,থানা পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশের সাথে বিশেষ চুক্তি করেন বাস মালিক কর্তৃপক্ষ। সেই চুক্তির টাকা প্রতিমাসে পুলিশের নগদে বা বিকাশে পৌছিয়ে দেন বাস মালিক কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি কক্সবাজার পর্যন্ত ৩টি হাইওয়ে থানা পুলিশ ও ৩টি ট্রাফিক পুলিশের বিকাশ ও নগদে লেনদেনের রেকর্ড ও তথ্য এসেছে প্রতিবেদকের হাতে।

শুক্রবার রামুর রাবার বাগান এলাকায় কথা হয় আলী আহমদ এক ছারপোকা ড্রাইভারের সাথে। তিনি জানান, আগে চাঁদার পরিমাণ কম ছিল। হয়রানিও কম করত। এখন চাঁদার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। টাকা না দিলে গাড়ি দাঁড় করে রাখে। পাশে সাইড করে রেখে অতিরিক্ত টাকার জন্য চাপ দেয়। আমার লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেসসহ সব কাগজপত্র ঠিক থাকলেও এসব টাকা দিতেই হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি পরিবহনের কর্মকর্তা জানান, আমার কোম্পানির যাত্রীবাহী এসি বাস রয়েছে ৩৫টি। এসব বাস চট্টগ্রাম থেকে প্রতিদিন কক্সবাজার চলাচল করে। সড়কে এসব বাস চলাচলে বিভিন্ন সময় পুলিশের হয়রানি ও মামলার শিকার থেকে বাচতে চিরিঙ্গা হাইওয়ে থানা পুলিশকে ১০ হাজার টাকা, মালুমঘাট হাইওয়ে থানা পুলিশকে ১০ হাজার টাকা, রামু হাইওয়ে থানা পুলিশকে ১০ হাজার টাকা, চকরিয়া ট্রাফিক পুলিশকে ৬ হাজার টাকা, ঈদগাহ ট্রাফিক পুলিশকে ৪ হাজার টাকা ও কক্সবাজার জেলা ট্রাফিক পুলিশকে ২০ হাজার টাকা দিতে হয়। ট্রাফিক পুলিশ, থানা পুলিশ ও হাইওয়ে থানা পুলিশদের প্রতিমাসে টাকা না দিলে বিভিন্ন মামলার শিকার হতে হয়। এভাবে হয়রানি ও মামলার ভয় দেখিয়ে অর্ধশত কোম্পানির যাত্রীবাহি বাস থেকে প্রতিমাসে ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন বলে পুলিশের কর্মকর্তারা।

তিনি আরোও জানান, এসব চাঁদা উত্তোলনে আবার রশিদও দেয়া হচ্ছে। লাল, হলুদ অথবা গোলাপি রঙের এসব রশিদে থাকছে চাঁদার নির্ধারিত অংক। লাইনম্যান দিয়ে চাঁদা তোলা হলেও ক্ষেত্র বিশেষ পুলিশের সদস্যরাও নিজ হাতেই গ্রহণ করছেন চাঁদার অর্থ।

সরেজমিনে দেখা যায়, হাইওয়ে থানা পুলিশের সদস্য ও ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোষ্ট বসিয়ে বিভিন্ন মালবাহী ট্রাকের চালকদের কাছ থেকে প্রতিদিন হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।

এছাড়াও কুরিয়ার সার্ভিস পরিবহণ, যাত্রীবাহী লেগুনা, সিএনজি অটোরিকশা, ভাড়ায় চালিত প্রাইভেট কার, রেজিষ্ট্রেশন বিহীন ডাম্পার ও বিভিন্ন অবৈধ পরিবহন মালিক ও চালকদের কাছ থেকে প্রতিমাসে টোকেনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগও রয়েছে ট্রাফিক পুলিশ ও হাইওয়ে থানা পুলিশের বিরুদ্ধে।

জানতে চাইলে রামু ক্রসিং হাইওয়ে থানার ওসি মেজবাহ উদ্দিন মাসিক মাসোহারার বিষয়টি অস্বীকার করেন।

জানতে চাইলে মালুমঘাট হাইওয়ে থানার ওসিও টোকেন ও মাসোহারার বিষয়টি অস্বীকার করেন।

জানতে চাইলে চিরিঙ্গা হাইওয়ে থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মোবাইলে সংযোগ না পাওয়ায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

জানতে চাইলে কক্সবাজার ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ জসিম উদ্দিন চৌধুরী, ট্রাফিক বিভাগের মাসিক আর্থিক লেনদেন বা মাসোহারার বিষয়টি আমার জানা নেই। কে বা কোন কর্মকর্তা টাকাগুলো নেয় যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পায় তদন্ত করে ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।

জানতে চাইলে হাইওয়ে কুমিল্লা রিজিওনের পুলিশ সুপার মহাম্মদ রহমত উল্লাহ বলেন, অর্ধশত বাস ও অন্যান্য বহন থেকে মাসিক মাসোহারা ও টোকেনের ব্যাপরে জানা নেই। খোজ নিয়ে যদি সত্যতা পাওয়া যায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পাশাপাশি পুলিশের কিছু বিপথগামী সদস্য ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে নির্ধারিত হারে চাঁদা উত্তোলন করছেন। এক্ষেত্রে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও সময়মতো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না বলেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে তারা। এ জাতীয় সমস্যা নিরসনে ট্রাফিক ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের পরিবহন ব্যবসায় নির্ধারিত আইন করা যেতে পারে। পাশাপাশি চাঁদা উত্তোলনের ক্ষেত্রে পুলিশের সচ্ছতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সচেতন মহল।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: