
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) প্যারাসাইটোলজি বিভাগের এক গবেষণায় প্রাণী ও মানুষের দেহে ক্ষতিকর অন্ত্রপরজীবীর সংক্রমণের প্রমাণ মিলেছে। গবেষণাটি চালিয়েছেন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সহিদুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি গবেষক দল, যেখানে ছিলেন স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী বেনী আমীন ও স্নাতক শিক্ষার্থী মো. আশিকুজ্জামান।
গবেষণাটির পদ্ধতি সম্পর্কে বাকৃবির স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী বেনী আমীন বলেন, গবেষণাটি ময়মনসিংহ শহরের রেলওয়ে কলোনি সংলগ্ন একটি ঘনবসতিপূর্ণ বস্তি এলাকায় পরিচালিত হয়। পশু পাখি থেকে কিছু কিছু জীবাণু মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে যেতে পারে। আমরা এই জীবাণুগুলোকেই শনাক্ত করার চেষ্টা করেছি।
মো. আশিকুজ্জামান বলেন, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, কবুতরসহ শিশু ও বয়স্কদের মল, পানির নমুনা এবং মাটিসহ ১০২টি নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে ডিএনএ নিষ্কাশন করা হয়। পরে “পিসিআর ও সিকোয়েন্সিং” এর মাধ্যমে জীবাণু শনাক্ত করা হয়।
গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, অন্ত্রের ডায়রিয়াজনিত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পরজীবী-ক্রিপ্টোস্পোরিডিয়াম, ব্লাস্টোসিস্টিস এবং জিয়ারডিয়া-এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
অধ্যাপক সহিদুজ্জামান বলেন, এই জীবাণুগুলোর কিছু উপ-প্রজাতি পশু-পাখি থেকে মানুষে এবং মানুষ থেকেও পশু-পাখিতে সংক্রমিত হতে পারে। এর মাধ্যমে আন্তঃপ্রজাতিগত সংক্রমণের ঝুঁকির বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
গবেষণায় সবচেয়ে বেশি নমুনায় পাওয়া গেছে ব্লাস্টোসিস্টিস পরজীবীটি, যা শনাক্ত হয়েছে ২৪টি নমুনায়। এটি গরু, ছাগল ও হাঁস-মুরগির দেহে ব্যাপকভাবে পাওয়া গেলেও মানুষের দেহে অপেক্ষাকৃত কম পাওয়া গেছে। ছাগলের সবগুলো নমুনায় ব্লাস্টোসিস্টিসের উপস্থিতি ছিল, যা গবেষকদেরও বিস্মিত করেছে। শনাক্ত হওয়া সাতটি সাবটাইপের মধ্যে এসটি২ ও এসটি৩ মানুষের দেহে এবং এসটি২৩ ও এসটি২৪ প্রাণী ও পাখির দেহে পাওয়া গেছে। একই বাড়িতে থাকা ছাগল ও মুরগির শরীরে একই সাবটাইপ পাওয়া, সংক্রমণের অভ্যন্তরীণ চক্রের ইঙ্গিত দেয়।
ক্রিপ্টোস্পোরিডিয়াম পাওয়া গেছে ৮টি নমুনায়, যার মধ্যে একটি ছিল মানুষের দেহের। সেখানে পাওয়া যায় 'ক্রিপ্টোস্পোরিডিয়াম পারভাম'-এর একটি সাবটাইপ, যা সাধারণত প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়। এছাড়া তিনটি ছাগল, তিনটি মুরগি ও মাটির একটি নমুনাতেও এই পরজীবীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। মাটির নমুনায় শনাক্ত হয় ক্রিপ্টোস্পোরিডিয়াম মেলিয়াগ্রেডিস, যা মূলত পাখিজনিত।
তবে জিয়ারডিয়া ইন্টেসটাইনালিস শুধু একটি মাটির নমুনায় পাওয়া গেছে। অধ্যাপক সহিদুজ্জামান ধারণা করেন, এটি ওই এলাকার প্রাণী বা মানুষের মল থেকেই এসেছে।
সংক্রমণের কারণ হিসেবে অধ্যাপক সহিদুজ্জামান বলেন, “বস্তি এলাকার অপরিকল্পিত পয়ঃনিষ্কাশন, পশুপাখির যত্রতত্র বিচরণ এবং নোংরা পরিবেশ এইসব পরজীবীর বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।” দূষিত পানি ও মাটির সংস্পর্শে এসে মানুষ এবং প্রাণী উভয়েই আক্রান্ত হতে পারে। বিশেষ করে পরিত্যক্ত আবর্জনা থেকে গবাদিপশু সংক্রমিত হয় এবং এসব পশু ও পাখির মাধ্যমে সংক্রমণ মানুষের দেহে ছড়িয়ে পড়ে। নালায় জীবাণু ছড়িয়ে পড়ায় ওই পানি ব্যবহারের সময়-যেমন গোসল, কাপড় ধোয়া বা বাসন পরিষ্কারের সময়-সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে।
সংক্রমণ প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন অধ্যাপক সহিদুজ্জামান। তিনি বলেন, “অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অপরিকল্পিত পয়ঃনিষ্কাশন এবং পশুপাখির মল যত্রতত্র পড়ে থাকার মতো সমস্যাগুলো নিরসন করা জরুরি।”
তিনি আরও বলেন, “বস্তির মতো এলাকায় সুপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পশুপাখির সঠিক নিয়ন্ত্রণ এবং জনসচেতনতা বাড়ালে এই ধরনের সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব।”
গবেষণাটি ছিল একটি পাইলট প্রকল্প বা প্রাথমিক অনুসন্ধানমূলক কাজ। অধ্যাপক সহিদুজ্জামান জানান, “যে-সব তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে, তা আরও বৃহত্তর গবেষণার ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।” তিনি আশা প্রকাশ করেন, দেশের বিভিন্ন বস্তি ও ঘিঞ্জি এলাকায় এ ধরনের গবেষণা পরিচালিত হলে পরজীবী সংক্রমণের প্রকৃত অবস্থা স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে। তিনি সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেন।
গবেষণা দলের মতে, জনস্বাস্থ্য রক্ষায় মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশকে একত্রে বিবেচনা করে ‘ওয়ান হেলথ’ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। অন্ত্রপরজীবী সংক্রমণ রোধে নিরাপদ পানি, সুপরিকল্পিত পশুপাখি ব্যবস্থাপনা ও বর্জ্য নিষ্কাশন এবং সর্বস্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি।
আরমান/সাএ
সর্বশেষ খবর
ক্যাম্পাস এর সর্বশেষ খবর