
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে রাষ্ট্রীয় ব্যবসার কোনো বিকল্প নেই বলে জোরালো মত দিয়েছেন সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজের ব্যবসায় শিক্ষা শাখার শিক্ষার্থী মোঃ আল আমীন। তার সুচিন্তিত প্রজেক্টে তিনি রাষ্ট্রীয় ব্যবসার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে যে সকল সুফল আসবে তা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন। তার মতে, এটি বাস্তবায়িত হলে কৃষক থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত সবাই উপকৃত হবে এবং সিন্ডিকেটমুক্ত একটি উন্নত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই রাষ্ট্রীয় ব্যবসার সফল উদাহরণ রয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য অনুসরণীয় হতে পারে।
রাষ্ট্রীয় ব্যবসার সুফলসমূহ
মোঃ আল আমীন তার প্রজেক্টে রাষ্ট্রীয় ব্যবসার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুফল তুলে ধরেছেন:
কৃষকের ন্যায্যমূল্য ও সিন্ডিকেট দমন: রাষ্ট্র সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করবে, ফলে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবেন। এতে কৃষিকাজে তাদের আগ্রহ বাড়বে এবং বাজারের সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব হবে। এই ক্রয় প্রক্রিয়া পরিচালনার জন্য সৎ ও দক্ষ ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা গঠিত সরকারি বিভাগীয় সংগঠন বা কমিটি থাকবে।
বেকারত্ব হ্রাস ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি: রাষ্ট্রীয় ব্যবসার ফলে প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, যা বেকারত্ব কমাতে সাহায্য করবে। শিক্ষার্থীরাও পড়াশোনার পাশাপাশি কাজের সুযোগ পাবে।
দ্রব্যমূল্যের লাগাম সরকারের হাতে: যখন সরকার নিজেই পণ্য ক্রয় ও বিক্রয়ের সাথে জড়িত থাকবে, তখন দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতেই থাকবে। এতে বাজারে অস্থিরতা কমবে এবং কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধি রোধ করা যাবে।
ভোক্তা অধিকার ও ব্যবসায়ীদের জবাবদিহিতা: সরকার সিন্ডিকেট সংক্রান্ত বিষয়ে জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হবে না। একই সাথে, অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা বিক্রেতারা তাদের ক্রেতা ধরে রাখার জন্য পণ্যের দাম কমাতে বাধ্য হবে, যা ভোক্তাদের জন্য লাভজনক হবে।
অবৈধ মজুদ রোধ: রাষ্ট্রীয় সুপার মার্কেট থেকে পণ্য কেনার সুযোগ থাকায় অসাধু ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে পণ্য মজুদ করা থেকে বিরত থাকবে।
সেবার মান ও মূল্য: রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সেবার মান বৃদ্ধি পাবে এবং মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে।
রাষ্ট্রীয় মুনাফা ও করের বোঝা হ্রাস: রাষ্ট্রীয় ব্যবসার মাধ্যমে অর্জিত মুনাফা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা পড়বে, যা জনগণের উপর থেকে করের বোঝা কমাতে সহায়ক হবে।
টিসিবি'র পণ্যের দুর্ভোগের অবসান: টিসিবি'র (TCB) পণ্যের জন্য সাধারণ মানুষকে আর রোদে পুড়ে বা লাইনে দাঁড়িয়ে কষ্ট করতে হবে না। রাষ্ট্রীয় সুপার মার্কেট থেকেই সহজে পণ্য পাওয়া যাবে।
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনৈতিক সংস্কার: রাষ্ট্রীয় ব্যবসার ফলে মুদ্রাস্ফীতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে এবং বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
বৈষম্য দূরীকরণ ও স্মার্ট বাংলাদেশ: এই পদক্ষেপ একচেটিয়া কারবার, অপকৌশল, অসৎ প্রভাব এবং ধনী-দরিদ্র, জাতি-ধর্ম-বয়স নির্বিশেষে সকল বৈষম্য দূর করতে সাহায্য করবে। এর ফলশ্রুতিতে 'স্মার্ট বাংলাদেশ' গড়ার স্বপ্ন বাস্তব রূপ লাভ করবে।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রীয় ব্যবসার উদাহরণ
আল আমীন উল্লেখ করেন, ফ্রান্স ও জার্মানির মতো উন্নত দেশগুলোতে রাষ্ট্রীয় ব্যবসা বেশ জনপ্রিয়। এর বাইরেও বিশ্বের অনেক দেশেই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ বা ব্যবসা সফলভাবে পরিচালিত হচ্ছে, যা জনকল্যাণ ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করেছে।
নরওয়ে: রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি ইকুইনর (Equinor) নরওয়ের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। এর মুনাফা 'গ্লোবাল পেনশন ফান্ডে' জমা হয়, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিনিয়োগ করা হয়। এটি কেবল রাষ্ট্রের রাজস্ব বাড়ায় না, বরং জনগণকে দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক সুরক্ষা দেয়।
সিঙ্গাপুর: সিঙ্গাপুরের সরকারি বিনিয়োগ সংস্থা তেমাসেক হোল্ডিংস (Temasek Holdings) বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অনেক সফল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল মুনাফা অর্জন করে না, বরং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
চীন: চীনের অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের ভূমিকা বিশাল। বিদ্যুৎ, রেলওয়ে, টেলিযোগাযোগ, ব্যাংক এবং অন্যান্য কৌশলগত খাতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখে এবং মূল্য স্থিতিশীলতায় অবদান রাখে।
ভারত: ভারতের ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (FCI) কৃষকদের কাছ থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে এবং রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে সুলভ মূল্যে তা জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়, যা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং কৃষকদের ন্যায্যমূল্য পেতে সাহায্য করে।
কানাডা: কানাডায় বিদ্যুৎ, পানি এবং অন্যান্য মৌলিক সেবার অনেক প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন, যা নাগরিকদের সুলভে পরিষেবা পেতে সাহায্য করে এবং মুনাফা জনকল্যাণে ব্যবহৃত হয়।
এসব উদাহরণ প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্রীয় ব্যবসা কেবল একটি ধারণা নয়, বরং এটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব এবং এর মাধ্যমে একটি দেশের অর্থনীতি ও জনজীবনকে স্থিতিশীল রাখা যায়।
রাষ্ট্রীয় ব্যবসার পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা
বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে মোঃ আল আমীন তার প্রজেক্টে ধাপে ধাপে রাষ্ট্রীয় ব্যবসা বাস্তবায়নের কৌশল বর্ণনা করেছেন:
সুপার মার্কেট স্থাপন: প্রাথমিকভাবে দেশের ৮টি বিভাগীয় শহরে ৮টি বৃহৎ রাষ্ট্রীয় সুপার মার্কেট নির্মাণ করতে হবে। এই সুপার মার্কেটগুলো বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট সরকারি মন্ত্রণালয়গুলো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। তার মতে, এই রাষ্ট্রীয় সুপার মার্কেট ছাড়া 'স্মার্ট বাংলাদেশ' নির্মাণ সম্ভব নয়।
পণ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ: কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি কাঁচামাল (পেঁয়াজ, রসুন, আদা, আলু ইত্যাদি) ক্রয় করা হবে। প্রক্রিয়াজাতকরণ যোগ্য পণ্য যেমন ধান, গম, তেল ইত্যাদি রাষ্ট্র নিজেই প্রক্রিয়াজাত করে পরিপূর্ণ পণ্য হিসেবে ভোক্তাদের কাছে উপস্থাপন করবে। আল আমীনের মতে, রাষ্ট্র নিজেই যদি প্রক্রিয়াজাতকরণের দায়িত্ব নেয়, তাহলে খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, যা জনগণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মিনারেল ওয়াটারের উদাহরণ দিয়ে দেখান কিভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চ মুনাফা করছে, যেখানে উৎপাদন খরচ অনেক কম।
পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা: বিভাগীয় পর্যায়ে সুপার মার্কেট স্থাপনের ফলে কৃষকরা অল্প সময়ে এবং অল্প খরচে তাদের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি সুপার মার্কেটে পৌঁছে দিতে পারবে। যদি কৃষকদের পরিবহন খরচ বহনে সমস্যা হয়, তবে রাষ্ট্রীয় সুপার মার্কেট কর্তৃপক্ষ স্বল্পমূল্যে পরিবহন সেবা প্রদান করবে এবং সেই খরচ কৃষকের পণ্যের মূল্য থেকে কেটে রাখা হবে। আল আমীন মনে করেন, রাষ্ট্রের কাছে পর্যাপ্ত স্থল ও নৌপথের পরিবহন ব্যবস্থা রয়েছে; প্রয়োজনে তা আরও বাড়াতে হবে। নিরাপদ খাদ্য পরিবহনের জন্য সর্বদা পরিবহন ব্যবস্থা প্রস্তুত রাখতে হবে। কৃষকদের জন্য ফ্রি হটলাইন নম্বর এবং রাষ্ট্রীয় সুপার মার্কেটের ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রচারের ব্যবস্থা থাকবে।
নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা
রাষ্ট্রীয় সুপার মার্কেটের নিরাপত্তা এবং সুচারু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে আল আমীন নিম্নলিখিত প্রস্তাবনা দিয়েছেন:
অগ্নিনির্বাপণ ও সুরক্ষা: প্রতিটি সুপার মার্কেটে আধুনিক অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা স্থাপন করতে হবে এবং এর পাশে ফায়ার সার্ভিসের একটি ছোট ইউনিট ২৪ ঘণ্টা প্রস্তুত রাখতে হবে, যাতে যেকোনো দুর্ঘটনা থেকে পণ্য ও কর্মীরা সুরক্ষিত থাকেন।
শৃঙ্খলা ও নজরদারি: সুপার মার্কেটগুলোতে বিশৃঙ্খলা এড়াতে সিসিটিভি ক্যামেরা, ম্যাজিস্ট্রেট, ম্যানেজার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী (গেটে) এবং গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের (ভিতরে) সর্বদা নিয়োজিত রাখতে হবে।
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (CEO): সকল রাষ্ট্রীয় সুপার মার্কেটের কার্যক্রম সুচারুভাবে পরিচালনার জন্য একজন সৎ ও ব্যবসা সম্পর্কে অভিজ্ঞ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (CEO) নিয়োগ করা যেতে পারে, যিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জবাবদিহি করবেন এবং সকল সুপার মার্কেট কঠোরভাবে তত্ত্বাবধান করবেন।
পারমাণবিক যুদ্ধ ও খাদ্য নিরাপত্তা: বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে (তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা) পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তা থেকে খাদ্যদ্রব্য সুরক্ষিত রাখার জন্য সুপার মার্কেটের সুরক্ষাবলয় নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
মোঃ আল আমীন ১০০% আত্মবিশ্বাসী যে এই প্রজেক্ট সফল হবে এবং রাষ্ট্রই একমাত্র ভোক্তার বিশ্বাস অর্জন করতে পারবে। তার এই প্রজেক্ট দেশের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় এবং একটি উন্নত, সমৃদ্ধ 'স্মার্ট বাংলাদেশ' গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
সর্বশেষ খবর
এক্সক্লুসিভ এর সর্বশেষ খবর