
দ্বীপ জেলা ভোলার চরফ্যাশনে কৃষকরা এই প্রথম বস্তায় আদা চাষ শুরু করেছেন। উপজেলার কৃষিতে নতুনত্ব আনার এই প্রয়াস দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। জমি ও মাটির সীমাবদ্ধতা, বন্যা বা লোনা জলের ঝুঁকি এবং কৃষি জমির উচ্চমূল্যের কারণে অনেক কৃষক যখন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছেন, তখন বস্তায় আদা চাষ তাদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
নদীবেষ্টিত চরফ্যাশনে প্রায়ই মৌসুমি বন্যা ও জোয়ারের পানিতে ফসলের ক্ষতি হয়। কিন্তু বস্তায় চাষ করার সুবিধা হলো মাটি সহজে সরানো যায় এবং উঁচু জায়গায় রাখা যায়, যা বন্যার পানি থেকে ফসলকে রক্ষা করে। কৃষকরা পুরোনো চালের বস্তা, প্লাস্টিকের বস্তা এমনকি পরিত্যক্ত বালুর বস্তাও ব্যবহার করছেন। এই পদ্ধতিতে প্রাথমিক খরচ কম। একটি বস্তা, কিছু জৈব সার, বেলে দোআঁশ মাটি ও আদার বীজ—এইগুলোই প্রধান উপকরণ।
উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, আসলামপুর, হাজারীগঞ্জ, জাহানপুর, আব্দুল্লাহপুর, চর মাদ্রাজ ও চরফ্যাশন পৌরসভা সহ বিভিন্ন এলাকার কৃষকরা বস্তায় আদা চাষ করছেন। চলতি বছরে ১২ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে আদা চাষের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও, তা ছাড়িয়ে ১৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আদা চাষাবাদ হয়েছে।
আসলামপুর ইউনিয়নের কৃষক মো. বারেক জানান, আগে বর্ষাকালে জমিতে চাষাবাদ করা যেত না। কিন্তু এখন বারো মাস বস্তায় আদা চাষ করা সম্ভব। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা পাচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ৩০০ বস্তায় আদা চাষ করছেন এবং খুব সহজেই সার ও পানি দেওয়া যাচ্ছে।
পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মাওলানা ইউসুফ বলেন, পার্বত্য জেলাসহ দেশের কয়েকটি জেলায় আদা চাষ হলেও, চরফ্যাশনে এই প্রথম উপজেলা কৃষি অফিসের সহায়তায় বস্তায় আদা চাষ শুরু হয়েছে। বাড়ির উঠান বা রাস্তার পাশে পতিত জমিতেও আদা চাষ করা যাচ্ছে। তিনি আরও জানান, এ বছর প্রাথমিকভাবে ২০০ বস্তায় আদা চাষ করছেন এবং বৈশাখ মাস থেকে চারা রোপণ করেছেন। আশা করা যায়, ১০-১২ মাস পর প্রতিটি বস্তা থেকে প্রায় ৩ কেজি আদা পাওয়া যাবে।
স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অফিস জানায়, বস্তায় আদা চাষে রোগবালাই তুলনামূলকভাবে কম হয়। পোকামাকড়ের আক্রমণ হলে আক্রান্ত বস্তা আলাদা করে সরিয়ে নেওয়া যায় বলে রোগ ছড়ানোর ঝুঁকিও কম থাকে। এতে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার কমে যায়, যা পরিবেশের জন্য ভালো। বিশেষ করে যুবসমাজ ও নারী উদ্যোক্তারা স্বল্প পুঁজি ও অল্প জায়গায় এই চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। অনেকে নিজেদের উঠোন বা বারান্দায় বস্তা রেখে এই চাষ করছেন। তবে ভালো ফলনের জন্য বস্তার মাটি ও জৈব সার ভালোভাবে মিশিয়ে তৈরি করতে হয়। নিয়মিত পানি দিতে হয় এবং অতিরিক্ত পানি যাতে জমে না থাকে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হয়।
কৃষি অফিস জানিয়েছে, তারা স্থানীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করছে এবং উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ে কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন। আদা একটি লাভজনক মসলা ফসল এবং বাজারে এর চাহিদা সারা বছর থাকে। বস্তায় উৎপাদিত আদা আকারে মাঝারি হলেও এর গুণাগুণ ভালো এবং দামও ভালো পাওয়া যায়। অনেকে বীজ উৎপাদনের জন্যও বস্তায় আদা চাষ করছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাজমুল হুদা বলেন, চরফ্যাশনের অনেক জমি বর্ষায় ডুবে যায়। তাই বস্তায় আদা চাষ এই অঞ্চলের জন্য একটি বড় সম্ভাবনা। কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে এবং তারা এটি শিখে অন্য ফসল যেমন হলুদ, আলু, মিষ্টি আলু, কচু ইত্যাদি চাষ করতে পারবে।
বলা যায়, বস্তায় আদা চাষ শুধু জমি সাশ্রয়ী বা বন্যা-সহনশীল পদ্ধতি নয়, এটি স্থানীয় অর্থনীতিতে নতুন প্রাণসঞ্চার করবে এবং কৃষকদের আয় বাড়াতে ও স্বনির্ভর হতে সাহায্য করবে।
সর্বশেষ খবর