
গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার বালাসীঘাটে চলন্ত নৌকার ছই ভেঙে পড়ে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী রিয়া মনি (১২) গুরুতর আহত হয়। এতে তার মেরুদণ্ড ভেঙে যায় এবং মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মূত্রথলি। বর্তমানে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে ব্যথা আর যন্ত্রণায় দিন কাটছে ছোট্ট এই মেয়েটির।
গত রোজার ঈদের দিন বালাসিঘাটে বান্ধবীদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছিল রিয়া। সেদিনের আনন্দময় উৎসব মুহূর্তেই রূপ নেয় বিভীষিকায়, যখন একদল যুবকের উচ্ছৃঙ্খল নাচানাচিতে চলন্ত নৌকার ছই ভেঙে পড়ে তার শরীরের ওপর। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা জানান, তার মেরুদণ্ড চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে এবং মূত্রথলিতেও জটিলতা দেখা দিয়েছে।
রিয়া গাইবান্ধা সদর উপজেলার খোলাহাটি ইউনিয়নের গোদারহাট গ্রামের দিনমজুর রাজু মিয়া ও সাজেদা বেগম দম্পতির একমাত্র সন্তান। সে স্থানীয় রায়দাসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। মেধাবী ও প্রাণোচ্ছ্বল এই মেয়েটি ইউনিয়ন পর্যায়ের দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিল, খেলাধুলা আর পড়াশোনায় ছিল দারুণ আগ্রহী।
সরেজমিনে রিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, এক কোণায় চেয়ারে বসে নিরব তাকিয়ে আছে ছোট্ট রিয়া। তার মুখে ক্লান্তি আর যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট। কোনো শব্দ নেই, মুখে নেই কোনো আবেগ—শুধু অপলক চাহনি। পাশে বসে থাকা মা সাজেদা বেগম হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন, যেন মেয়ের যন্ত্রণা কিছুটা লাঘব করতে চান।
রিয়ার মা বলেন, “রিয়ার মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। একা বসতে বা শুতে পারে না। সবসময় আমাকে সাহায্য করতে হয়। ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করতাম। মেয়ের দুর্ঘটনার পর সব ছেড়ে গ্রামে চলে এসেছি। চার মাস ধরে রংপুরে চিকিৎসা চলছে। সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। ঋণ করেও চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছি।”
তিনি আরও বলেন, “চিকিৎসকরা বলেছেন, উন্নত ফিজিওথেরাপি, নিয়মিত চিকিৎসা ও অপারেশন করাতে পারলে রিয়া সুস্থ হতে পারে। কিন্তু এতো খরচ বহন করার সামর্থ্য আমাদের নেই। সরকার ও দেশের বিত্তবানদের কাছে আমরা মেয়ের চিকিৎসার জন্য সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছি।”
রিয়ার সঙ্গে সেদিন বালাসীঘাটে ঘুরতে যাওয়া বান্ধবী রাদিয়া জানায়, “ঈদের দিন আমরা চারজন বান্ধবী মিলে ঘুরতে গিয়েছিলাম। নৌকায় ফেরার সময় এক হিজড়া ও কয়েকজন যুবকের নাচানাচির সময় ছই ভেঙে পড়ে রিয়ার ওপর। বাকিরা বের হয়ে এলেও রিয়াকে টেনে তুলতে হয়। তখনও ভাবিনি এমন কিছু হয়ে যাবে।”
রিয়ার চাচী রুবি বেগম বলেন, “ঈদের দিনে অটোতে করে যখন রিয়াকে আনা হয়, তখন সে এক পা ফেলতেও পারছিল না। পিঠে ছিল গুরুতর আঘাত। গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে নেওয়া হলেও সেদিন কোনো চিকিৎসা মেলেনি। পাঁচদিন পর রংপুরে নেওয়া হয়।”
রিয়ার স্কুলের প্রধান শিক্ষক শাহাজাদী হাবিবা সুলতানা বলেন, “রিয়া পড়াশোনায় অত্যন্ত মনোযোগী ও খেলাধুলায় সক্রিয়। ওর মতো একটি শিশুর জীবন অর্থাভাবে থেমে যাক, এটা মেনে নেওয়া যায় না। সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদের কাছে অনুরোধ করছি, ওর পাশে দাঁড়ান।”
এদিকে স্থানীয়রা বলছেন, রিয়া ছিল সবার আদরের। পরিবারের আর্থিক অবস্থা একেবারেই দুর্বল। সরকার ও সমাজের সামর্থ্যবানদের এগিয়ে আসা এখন সবচেয়ে জরুরি। সেইসঙ্গে রিয়ার চলাফেরার জন্য জরুরি ভিত্তিতে একটি হুইলচেয়ারের দাবি জানিয়েছেন তারা।
এ ব্যাপারে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহামুদুল হাসান বলেন, 'বিষয়টি আপনাদের মাধ্যমে জানলাম। ঘটনাটি বেদনাদায়ক এবং হৃদয় বিদারক। আমি রিয়া মনিকে দেখার জন্য নিজেই ওদের বাড়িতে যাব। বাচ্চাটির জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যথাসাধ্য আর্থিক সহযোগিতাসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হবে।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর