
আবদুল্লাহ শামীম সারা শরীরে ব্যান্ডেজ নিয়ে আইসিইউতে শুয়ে ছিল। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছিল ছোট্ট, সাহসী এক প্রাণ। আগুনে পুড়ে ঝলসে যাওয়া শরীরের যন্ত্রণা ভুলে সে তখন বড় বোন ফারজানা কনিকাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আমার শরীর কি অনেক পুড়েছে আপু?’
রাজধানীর জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) শুয়ে থাকা শামীমের ৯৫ শতাংশ দগ্ধ। তবুও কাঁপা কণ্ঠে ফারজানা তাকে সাহস দিয়ে বলেছিলেন, ‘না ভাইয়া, তোমার পোড়া বেশি নয়। তুমি ঠিকই ভালো হয়ে যাবে।’
সে কথা ছোট্ট শামীম হয়তো বিশ্বাস করেছিল। তবে সোমবার (২১ জুলাই) রাতের আঁধারে চিরতরে না ফেরার দেশে পাড়ি জমায় সে। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল আবদুল্লাহ শামীম। তার সাহস ছিল অদম্য। আগুনে ঝলসে যাওয়ার পরও সে নিজে হেঁটে গিয়েছিল সেনাবাহিনীর সদস্যদের কাছে। বলেছিল ‘আমাকে বাঁচান।’
ফারজানা বলেন, ‘আমার ভাইটার কত সাহস ছিল! শরীরের ৯৫ শতাংশ পুড়ে গেছে, তবুও সে নিজে হেঁটে গেছে সাহায্য চাইতে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরও নিজের মুখে আমাদের ফোন নম্বর বলেছিল ডাক্তারদের। তারাই আমাদের খবর দেন।’
ভাইকে যখন বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে খুঁজে পান ফারজানা, তখনো কথা বলেছিল সে। শেষবার বোনের কাছে একটু পানি খেতে চেয়েছিল-‘আপু, আমাকে একটু পানি দাও।’
ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে ফারজানা একটু পানি দিয়েছিলেন। তারপরই ভাইয়ের শেষ প্রশ্ন-‘আমার শরীর কি অনেক পুড়েছে আপু?’
ফারজানা বলেন, ‘আমি কীভাবে বলি তাকে যে তার শরীরের ৯৫ শতাংশ দগ্ধ! আমি শুধু বলেছি-না ভাইয়া, তুমি ভালো হয়ে যাবে। সাহস রেখ। কিন্তু আমার ভাই আর ফিরে আসেনি।’
মঙ্গলবার দুপুরে আবদুল্লাহর লাশ শরীয়তপুরে গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়েছে। তিন ভাইবোনের মধ্যে আবদুল্লাহ ছিল মেজো। ফারজানা বড়। শরীয়তপুর থেকে ফোনে কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন ফারজানা।
‘দীর্ঘ একটি রাত’ : মঙ্গলবার সকালে জাতীয় বার্ন ইউনিটের সামনে দাঁড়িয়ে সবার কাছে অনুরোধ করছিলেন আমিনুল ইসলাম জনি, আমি আমার স্ত্রীকে খুঁজে পাচ্ছি না। প্লিজ আমাকে একটু সাহায্য করুন। তিনি গতকাল থেকে তার স্ত্রীকে খুঁজছেন।
সোমবার যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের পর আমিনুল ইসলাম জনির স্ত্রী লামিয়া আক্তার সোনিয়া ছুটে যান মাইলস্টোন স্কুলে। তাদের মেয়ে জায়রা সেখানকার তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী।
আমিনুল ইসলাম জনি বলেন, ‘আমার মেয়েকে অচেনা একজনের সহায়তায় খুঁজে পেয়েছি। সে স্কুলের একপাশে বসে কাঁদছিল। কিন্তু আমি এখনো আমার স্ত্রীকে খুঁজে পাইনি।’
তিনি জানান, ইতোমধ্যে উত্তরার একাধিক হাসপাতাল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালেও (সিএমএইচ) খুঁজেছেন, কিন্তু কোথাও স্ত্রীকে পাননি।
তার ভাষ্য, ‘কেউ তাকে দেখেনি। আমরা শুধু তার জাতীয় পরিচয়পত্রের একটি পোড়া কপি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরতে দেখেছি। তাই আজ আবার বার্ন ইউনিটে খুঁজতে এলাম।’
সেখানে উপস্থিত থাকা আরেক স্বজন বলেন, ‘গত রাত ছিল হাজার রাতের চেয়ে দীর্ঘ একটি রাত।’
মঙ্গলবার সকাল থেকে ঢাকার বার্ন ইনস্টিটিউটে স্বজনরা ভিড় জমিয়েছেন। তাদের হাতে ছিল ছবি, স্কুলব্যাগ, ছেঁড়া পোশাক। যেন এগুলো দিয়ে প্রিয় সন্তান বা স্বজনকে শনাক্ত করা যায়।
রাইসা মনিকে পাওয়া গেল, তবে... : রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে মর্মান্তিক যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর থেকে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী রাইসা মনি নিখোঁজ ছিল। পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন স্থান ও হাসপাতালে খোঁজ করেও তার কোনো সন্ধান পাননি। অবশেষে রাইসার সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে সে আর বেঁচে নেই। হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থানে খোঁজখবরের পর ঢাকার সিএমএইচে তার লাশের সন্ধান মিলেছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে নিহত রাইসা মনির চাচা ইমদাদুল শেখ গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
রাইসা মনি (কোড-২০১০, সেকশন-স্কাই) মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী ছিল। নিখোঁজ রাইসা ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের বাজড়া গ্রামের শাহাবুল শেখের মেয়ে। তার চাচাতো ভাই তারিকুল শেখ গণমাধ্যমকে জানান, রাইসা মনির খোঁজ পাওয়া গেছে। তবে সে আর পৃথিবীতে বেঁচে নেই। তার বাবা নিজে মেয়ের লাশ শনাক্ত করেছেন।
উক্য সাইনকে হারিয়ে পাগলপ্রায় শিক্ষক বাবা-মা : মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহত সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী উক্য সাইন মারমা (১৩) মারা গেছে। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার (২১ জুলাই) রাত ৩টায় মৃত্যুবরণ করে সে। মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে উক্য সাইন মারমার বাবা উসাই মং মারমা। নিহত উক্য সাইন মারমা রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলার কলেজপাড়া এলাকার বাসিন্দা শিক্ষক দম্পতি উসাই মং মারমা ও তেজিপ্রু মারমার একমাত্র সন্তান। উক্য সাইন মাইলস্টোন কলেজের আবাসিক ছাত্র ছিল।
ছেলেকে আনতে গিয়ে মা এখনো নিখোঁজ, ফিরে এসেছে ছেলে : রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় স্কুল থেকে ছেলেকে আনতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন আফসানা প্রিয়া (৩০)। ছেলে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র আফসান ওহী (৯) অক্ষত অবস্থায় ফিরে এলেও আফসানা এখনো নিখোঁজ। মঙ্গলবার দুপুরে আফসানার স্বজনরা জানিয়েছেন, আড়াইটা পর্যন্ত হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া যায়নি। নিখোঁজ আফসানা গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চাপাইর ইউনিয়নের মেদীআশুলাই এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল ওহাব মৃধার স্ত্রী।
বাঁধন/সিইচা/সাএ
সর্বশেষ খবর