
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার গুলশানে সাবেক এক এমপির বাসায় সমন্বয়ক পরিচয়ে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির ঘটনা নিয়ে তোলপাড় চলছে। এ নিয়ে আলোচনা সমালোচনার মুখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটি ব্যতীত সব কমিটি স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে।
ওই ঘটনায় পুলিশের হাতে আটক হওয়া পাঁচজনকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ থেকে বহিষ্কারের করা হলেও জুলাই আন্দোলনের এসব প্লাটফর্ম ব্যবহার করে চাঁদাবাজির নানা অভিযোগ নতুন করে আলোচনায় আসছে বলে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার পতনের আন্দোলনে সক্রিয় থাকা অনেকের বিরুদ্ধেই গত বছর আগস্টের পর থেকেই ক্ষমতা প্রদর্শন, চাঁদাবাজি, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুবিধা আদায়, সচিবালয়ে তদবিরসহ নানা অভিযোগ আসছিল।
বিশেষ করে ঢাকাসহ সারা দেশে ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ তীব্র আকার ধারণ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি ছাড়াও শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের সঙ্গে জড়িত অনেকের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ উঠছে।
তিনটি সংগঠনের নেতারাই বলেছেন, এসব অভিযোগ সম্পর্কে তারা অবগত এবং অভিযোগ পাওয়া মাত্রই তারা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করেছেন। তাদের দাবি, সুযোগসন্ধানী একদল ব্যক্তি সংগঠনগুলোতে ভিড়ে এসব অপকর্ম করছে।
সমাজ অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক বলছেন, দৃশ্যমান কোনো দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণেই ‘সমন্বয়কের পরিচয়’ ব্যবহার করে মব তৈরি করে অর্থ আদায়ের প্রবণতা বেড়েছে। তার মতে, অর্থ আদায়ের জন্যই এসব পরিচয় ব্যবহার করা হচ্ছে।
গতকাল শনিবার রাতে রাজধানীর গুলশানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেত্রী শাম্মী আহমেদের বাসায় গিয়ে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগে পাঁচজনকে আটক করেছে পুলিশ।
এ ঘটনায় আজ চারজনের সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। তাদের আদালতে তোলার সময় আদালত প্রাঙ্গণে ‘চাঁদাবাজ’ ‘চাঁদাবাজ’ বলে স্লোগান দেয় উপস্থিত লোকজন।
গুলশান থানার ওসি মো. হাফিজুর রহমান বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে তারা চাঁদা দাবির কথা স্বীকার করেছে। এ সংক্রান্ত ভিডিও আছে। এটা ১৭ তারিখের।
চাঁদা দাবির অভিযোগে আটককৃতরা হলেন ইব্রাহিম হোসেন মুন্না, মো. সাকাদাউন সিয়াম, সাদাব, আমিনুল ইসলাম এবং আব্দুর রাজ্জাক বিন সুলাইমান রিয়াদ। তারা শাম্মি আহমেদের বাসায় গিয়ে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা চেয়েছিলেন এবং দশ লাখ টাকা গ্রহণ করেছিলেন বলে পুলিশ বলছে। বাকি টাকা আনতে গিয়েই তারা শনিবার পুলিশের হাতে আটক হন।
এর মধ্যে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের নেতা আব্দুর রাজ্জাক বিন সুলাইমান রিয়াদকে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আহবায়ক কমিটিরও নেতা।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি)র কয়েক জন নেতা গত কয়েকমাসে নানা ঘটনায় আলোচনায় এসেছেন। যুগ্ম সদস্যসচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরকে গত এপ্রিলে দল থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া ঢাকার ধানমণ্ডির একটি বাড়িতে সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে মব হামলার পর আটককৃতদের থানা থেকে ছাড়িয়ে এনে আলোচনায় এসেছিলেন এনসিপির আরেকজন নেতা আব্দুল হান্নান মাসুদ। তাকেও গত মে মাসে ওই ঘটনার পর দল থেকে শোকজ করা হয়েছিলো।
এর আগে গত বছর আগস্টের পর থেকে সারাদেশেই সমন্বয়ক পরিচয়ে ক্ষমতা প্রদর্শন, চাঁদাবাজি, তদবিরসহ নানা অভিযোগ আসতে থাকে।
গত বছর সেপ্টেম্বরে সাভারে সমন্বয়ক পরিচয়ধারী এক যুবককে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দের পর মামলা দায়ের করা হয়েছে। তিনি দলবল নিয়ে একটি বাড়িতে তল্লাশির জন্য গিয়ে চাঁদা দাবি করেছিলেন।
গত বছর ডিসেম্বরের প্রতারণা, চাঁদাবাজি ও মানহানির অভিযোগে করা এক মামলায় ফেনীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কথিত সমন্বয়ককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তিনি একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষের কাছে তিন লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিলেন।
এই প্লাটফর্মের রংপুরের এক নেতার গত মার্চ মাসে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবির ভিডিও এবং অডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হয়েছে।
চলতি বছরের এপ্রিলে খুলনা নগরীতে একটি বাড়িতে ঢুকে গোয়েন্দা পুলিশ-ডিবি ও সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে চার শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে জনতা।
আওয়ামী লীগ নেত্রী শাম্মী আহমেদের বাসায় চাঁদাবাজির ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাসহ পাঁচজন আটক হওয়ার পর এ ঘটনা ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা।
উমামা লিখেছেন, এ ঘটনায় অনেকে আশ্চর্য হওয়ার অভিনয় করছে, তিনিই সব থেকে কম আশ্চর্য হয়েছেন এবং এই আটকদের শেকড় অনেক গভীরে।
তার অভিযোগ, এই ব্যক্তিরা সচিবালয় থেকে শুরু করে মিছিল-মিটিং, মারামারি সব জায়গাতেই সমন্বয়কদের ডান হাত, বাম হাত হিসেবে নির্বিঘ্নে প্রটোকল দিয়ে গেছে।
গ্রেফতার হওয়া রিয়াদ নামের ব্যক্তি গত ডিসেম্বর মাসে রূপায়ন টাওয়ার উমামার সামনে অত্যন্ত উশৃঙ্খল আচরণ করেছিল উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, আমরা মেয়েরা তাকে থামানোর চেষ্টা করলে আমাদের উপর পাল্টা চড়াও হয়। ঐ ঘটনার পর ছেলেটার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে হুমকি, মারামারি ও চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে। উমামা এ বিষয়ে জেনে তখন মোটেও অবাক হননি বলে উল্লেখ করেছেন।
গুলশানের ঘটনার পর এনসিপি নেতা মাহিন সরকার তার ফেসবুক পাতায় দেওয়ার পোস্টের এক পর্যায়ে লিখেছেন, রিমান্ডে নিয়ে প্রকৃত কুশীলবদের বের করে আনাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কেননা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানার একটি ঐতিহাসিক ব্যানার। আমি ইতোপূর্বেও জানিয়েছি এই ব্যানার আর থাকার প্রয়োজন নেই, যদিও এই ব্যানার প্রতিষ্ঠা করতে আমারও ভূমিকা ছিলো।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ রাশেদ খাঁন ফেসবুকে লিখেছেন, এরা সরকারের দাপটেই এসব চাঁদাবাজি করছে। পদ ব্যবহার করে নিয়োগ, তদবির, বদলি বাণিজ্য, মামলা বাজিসহ এমন কোন কাজ নাই যে, তারা করছে না।
শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনের সময় নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। পরে এর একটি অংশ এনসিপি নামক রাজনৈতিক দল গঠন করে । আরেকটি অংশ ক্যাম্পাস ভিত্তিক রাজনীতির জন্য গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ গঠন করে। আর অরাজনৈতিক অংশটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামে সংগঠন পুনর্গঠন করে।
এখন গত কিছুদিন ধরে তিনটি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত অনেকের বিরুদ্ধেই চাঁদাবাজি ও তদবিরসহ নানা অভিযোগ আসছে। সংগঠনগুলোর ভেতর থেকেও অনেকে এসব বিষয়ে সোচ্চার হয়েছেন।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক ও মুখপাত্র আরিফুল ইসলাম আদীব বলছেন, অভিযোগ পাওয়া মাত্র অন্তত চারটি ঘটনায় তারা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছেন।
তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সবাই এনসিপির সঙ্গে আসেনি। আন্দোলনের সময় গড়ে ওঠা পরিচিতি থেকে কারও কারও একটা পাওয়ার তৈরি হয়েছে। এখন তার কাজের দায়ও আমাদের নিতে হচ্ছে। আমরা কোনো ঘটনা শুনলেই সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
এনসিপি বলছে, আন্দোলনের সময় স্থানীয়ভাবে অনেক কমিটি হয়েছে এবং তখন সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাতে শরীক হয়েছিলো। সমন্বয়ক পরিচয়ে যারা যুক্ত হয়েছে তাদের সাথে পরিচয় হয়েছে আন্দোলনের মাঠ থেকে। এখন সামনে আরও যাচাই বাছাই করবো। কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আসলে বা কোনো ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিবো। এটাই দলীয় অবস্থান।
অন্যদিকে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের সদস্য সচিব জাহিদ আহসান বলছে, গত ফেব্রুয়ারিতে তাদের সংগঠনটির যাত্রা শুরুর পর যখনই যে অভিযোগ এসেছে সে বিষয়ে তারা ব্যবস্থা নিয়েছেন।
অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক হাসান ইনাম বলছেন জুলাই আন্দোলনের প্লাটফর্ম হিসেবে নানা ধরনের মানুষ এক সাথে হয়েছে এবং সে সময় অল্প সময়ের মধ্যে তাদের সবাইকে চেনা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না।
তিনি বলছেন, এখন যে জুলাইতে সামনে ছিলো সে হয়তো সচিবালয়মুখী হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ পাওয়া মাত্রই ব্যবস্থা নিচ্ছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা বেগ পোহাচ্ছি। তবে আমরা জিরো টলারেন্স দেখাবো এমন বিষয়ে।
তার মতে, অভিযোগ অনেক আসায় সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করেছে। এরা সুযোগ সন্ধানী। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ এলেই আমরা তাদের পদ স্থগিত করবো। বহিষ্কার করবো, প্রয়োজনে আইনের হাতে তুলে দিবো।
সমাজ অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির অনেকেই চাঁদাবাজি, দখল দারিত্ব, ঘুস বাণিজ্য সহ এ ধরনের প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে।
তিনি বলছেন, সাংগঠনিক ব্যবস্থার প্রভাব দৃশ্যমান নয়। পূর্ব বোঝাপড়া করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিলে তা কোনো পরিবর্তনও আনবে না। কঠোর আইনগত ব্যবস্থা না নিলে রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে অপরাধ প্রবণতা বাড়বে।
তার মতে, যেসব অভিযোগ আসছে বা লোকমুখে যা শোনা যাচ্ছে – তার বেশিরভাগ নিয়েই শক্ত অবস্থান দেখা যায় না। ফলে মুখে যাই বলুক এর পেছনে বা ভেতরে দুর্বৃত্তায়নের সুযোগ কেউ কেউ নিচ্ছেন বলে মনে করেন তিনি।
বাঁধন/সিইচা/সাএ
সর্বশেষ খবর
রাজনীতি এর সর্বশেষ খবর