
গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরি ইউনিয়নের বির্তুল এলাকা সবুজে ঘেরা এক বিস্তৃত অঞ্চল। এখানকার উর্বর মাটি ও কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে উৎপাদিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ সবজি, যা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বাজারেও খ্যাতি লাভ করেছে।
বিশেষ করে এই অঞ্চলের ‘সোনালি ফসল’ হিসেবে পরিচিত কাঁকরোল তার অনন্য স্বাদ ও মানের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। শুধু কাঁকরোলই নয়, বির্তুল ও এর আশেপাশের এলাকা থেকে কাঁচকলা, কচু, কাঁঠাল, লিচু, কচুর লতি এবং বরবটির মতো বৈচিত্র্যময় সবজিও সারাদেশে সরবরাহ হচ্ছে।
এই অঞ্চলের কৃষকদের উৎপাদিত সেরা মানের সবজিগুলো আকাশপথে পাড়ি জমাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে, যা দেশের জন্য নিয়ে আসছে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু এই বিপুল সম্ভাবনার পেছনেই লুকিয়ে আছে এক গভীর সংকট। আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন একটি প্যাকিং হাউসের অভাবে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হচ্ছে রপ্তানির বিশাল সুযোগ। কৃষকরা তাদের সোনালি স্বপ্ন নিয়ে ফসল ফলালেও, গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই অর্ধেক পণ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তারা আর্থিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, তারা তাদের জমির সবচেয়ে ভালো এবং বাছাই করা সবজিগুলোই রপ্তানির জন্য আলাদা করেন। কিন্তু একটি আধুনিক প্যাকিং হাউসের অভাবে তাদের সনাতন পদ্ধতিতেই প্যাকেটজাত করতে হয়। এই পদ্ধতিতে পণ্যের আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ, সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখা এবং প্যাকেজিংয়ের সময় জীবাণুমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। ফলে দীর্ঘ বিমানযাত্রায় সবজিগুলো পচে যায় বা এর গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। গন্তব্যে পৌঁছানোর পর প্রায় অর্ধেক সবজি ফেলে দিতে হয়, যা আমদানিকারকদের কাছে বাংলাদেশি পণ্যের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে এবং কৃষকদের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করে।
এই বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে স্থানীয় সফল কৃষক মো. আব্দুল আলিম তার হতাশা ও বঞ্চনার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “আমি প্রতি বছর প্রায় ২০০ কেজির বেশি কাঁকরোল শুধুমাত্র বিদেশে রপ্তানি করার লক্ষ্যেই উৎপাদন করি। আমার জমির সেরা ফসলটাই আমি এর জন্য রাখি। কিন্তু ভালো করে প্যাকেট করার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বিদেশে পৌঁছাতে পৌঁছাতে মালের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। অর্ধেক দামে বিক্রি করতে হয়, কখনো বা পুরো চালানই লোকসান হয়। এতে আমাদের পরিশ্রম বৃথা যায়, আমরা ন্যায্য দাম পাই না।”
তার কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেল আরও অনেক কৃষকের কণ্ঠে। তাদের সকলের দাবি, যদি একটি আধুনিক প্যাকিং হাউস থাকত, তবে তারা সঠিক উপায়ে পণ্য প্রস্তুত করে বিদেশে পাঠাতে পারতেন। এতে তাদের আয় যেমন বাড়ত, তেমনি দেশেরও লাভ হতো।
এই সমস্যার সমাধানে স্থানীয় কৃষকরা একটি কার্যকর প্রস্তাব রেখেছেন। তারা জানিয়েছেন, নাগরি ইউনিয়নের উলুখোলা বাজারে, ইউনিয়ন পরিষদের পাশেই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নিজস্ব প্রায় ১২ শতাংশ জমি দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। জায়গাটির পাশেই পাকা সড়ক থাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত। কৃষকদের দাবি, এই জায়গাতেই যদি সরকার একটি আধুনিক প্যাকিং হাউস নির্মাণ করে দেয়, তাহলে পুরো অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।
একটি প্যাকিং হাউসে সবজি পরিষ্কার করা, গ্রেডিং বা আকার অনুযায়ী বাছাই করা, মান নিয়ন্ত্রণ, জীবাণুমুক্তকরণ এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্যাকেজিংয়ের সকল সুবিধা থাকবে। এর ফলে কৃষকরা তাদের পণ্য সরাসরি প্যাকিং হাউসে নিয়ে এসে সঠিক প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে রপ্তানির জন্য প্রস্তুত করতে পারবেন।
কৃষকদের এই যৌক্তিক দাবি ও সমস্যার বিষয়ে অবগত আছেন স্থানীয় প্রশাসন এবং কৃষি কর্মকর্তারা। তারা বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, কৃষিবিদ ফারজানা তাসলিম বলেন, “রাজধানীর এত কাছে থেকেও কালীগঞ্জের বেশিরভাগ এলাকা এখনো কৃষিপ্রধান, যা আমাদের জন্য একটি বড় শক্তি। এখানকার কৃষকদের উৎপাদিত ফসল দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশে যাচ্ছে, এটা অত্যন্ত গর্বের বিষয়। কিন্তু একটি উন্নত প্যাকিং হাউসের অভাবে কৃষকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি দেশও বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কৃষকদের এই দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক। আমি বিষয়টি আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি এবং এই অঞ্চলের জন্য একটি প্যাকিং হাউস নির্মাণের সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবো।”
এ বিষয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তনিমা আফ্রাদ আরও জোরালোভাবে কৃষকদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেন, “কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল ফলায়। সেই ফসল যদি ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর আগেই নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না। আমরা কৃষকদের এই দাবিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি এবং খুব দ্রুত একটি প্যাকিং হাউস নির্মাণের জন্য কাজ শুরু করব।”
তিনি আরও একটি সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে বলেন, “আমরা জানতে পেরেছি 'ঢাকা অঞ্চলের কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের' আওতায় এ ধরনের প্যাকিং হাউস নির্মাণের সুযোগ রয়েছে। আমরা সেই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে কালীগঞ্জের কৃষকদের দীর্ঘদিনের এই সমস্যার সমাধান করতে চাই। আশা করি, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাদের এই উদ্যোগে পূর্ণ সহযোগিতা করবে।”
কালীগঞ্জের কৃষকদের স্বপ্ন এখন একটি আধুনিক প্যাকিং হাউসকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। একদিকে রয়েছে কাঁকরোলের মতো উচ্চমূল্যের সবজির বিপুল উৎপাদন ও আন্তর্জাতিক বাজারে এর চাহিদা, অন্যদিকে রয়েছে প্রশাসনের ইতিবাচক মনোভাব এবং সহজলভ্য সরকারি জমি। এই দুইয়ের সমন্বয় ঘটানো গেলেই কালীগঞ্জের কৃষিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। একটি প্যাকিং হাউস শুধু কৃষকদের আর্থিক সচ্ছলতাই এনে দেবে না, বরং মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে বাংলাদেশের সবজির সুনাম বৃদ্ধি করবে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা যোগ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুত পদক্ষেপে এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে, এমনটাই প্রত্যাশা করছেন কালীগঞ্জের হাজারো কৃষক।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর