
জুলাই-আগস্টে হত্যাকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় দেশবাসী, আহত ও নিহতের পরিবার এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি এই মামলার রাজসাক্ষী।
মঙ্গলবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ এ অশ্রুসজল চোখে সাক্ষ্য দেন পুলিশের সাবেক প্রধান। তিনি মামলাটির আসামি হলেও সম্প্রতি রাজসাক্ষী হয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালে এদিন সাক্ষ্য দেওয়ার সময় আগের দেওয়া লিখিত জবানবন্দি পড়ে শোনান আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি বলেন, ‘আমি ৩৬ বছর পুলিশে চাকরি করেছি। পুলিশের চাকরি খুবই ট্রিকি। সবসময় পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে। কিন্তু চাকরি জীবনে আমার বিরুদ্ধে কখনো কোনো অভিযোগ আসেনি। আমি যথেষ্ট মানবিকতা ও সচেতনতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। তবে চাকরি জীবনের শেষ পর্যায়ে এত বড় গণহত্যা আমি দায়িত্বে থাকতে সংঘটিত হয়েছে। এর দায় আমি স্বীকার করছি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশে এই গণহত্যা সংঘটিত হয়।’
পুলিশের সাবেক প্রধান আরও বলেন, ‘গণহত্যার শিকার প্রত্যেক পরিবার, আহত ব্যক্তি, দেশবাসী ও ট্রাইব্যুনালের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আমাকে দয়া করে ক্ষমা করবেন।’
এ সময় আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন সাবেক এই আইজিপি। তিনি বলেন, ‘আমার এই সত্য ও পূর্ণ বর্ণনার মাধ্যমে সত্য উদঘাটন হলে আল্লাহ যদি আমাকে আরও হায়াত দান করেন বাকি জীবনে কিছুটা হলেও অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাব।’
চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, বৈষম্যরিবোধী আন্দোলন দমনের উদ্দেশে সরকারের আদেশে ছাত্র-জনতার ওপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করে আহত-নিহত করায় পুলিশ প্রধান হিসেবে আমি লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী। যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড হয়েছে এজন্য অপরাধবোধ ও বিবেকের তাড়নায় আমি রাজসাক্ষী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, গত বছরের ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তাল ছিল গোটা দেশ। ঠিক একদিন পরই ‘মার্চ টু ঢাকা’। আর এ কর্মসূচি ঠেকাতে আগের দিন রাতে গণভবেন ডাকা বৈঠকে নেওয়া হয় নানা পরিকল্পনা। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ওই বৈঠকে অংশ নেন শেখ রেহানা, মন্ত্রীসহ বিভিন্ন বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা। ৫ আগস্ট কোথায় কীভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে; সেসব সিদ্ধান্তও নেওয়া হয় বৈঠকে।
পুলিশের সাবেক প্রধান বলেন, সেদিন (৪ আগস্ট) গণভবনে বেলা ১১টায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নিরাপত্তা সমন্বয় কমিটির একটি বৈঠক হয়। সেখানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তিন বাহিনীর প্রধান, এসবির প্রধান, ডিজি ফআই, এনএ স আই প্রধানসহ কমিটির ২৭ জন অংশ নেন। আমি নিজেও ওই বৈঠকে ছিলাম। সেখানে আন্দোলন দমন ও নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে আলোচনা হয়। একপর্যায়ে বৈঠকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন পেশ করছিল গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এর মধ্যেই চারদিকের পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হওয়ায় বৈঠক মুলতবি করা হয়।
আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ওই রাতেই (৪ আগস্ট) আমাদের আবার গণভবনে ডাকা হয়। সেখানে আমি, আনিসুল হক, আসাদুজ্জামান কামাল, তিন বাহিনীর প্রধান, র্যাবের ডিজি উপস্থিত ছিলেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে শেখ রেহানাও ছিলেন। আর বাইরে অপেক্ষমান ছিলেন ডি জি এফ আই ও এসবির প্রধান। ওই বেঠকে ৫ আগস্ট 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি ঠেকানোর পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। পুলিশ-সেনাবাহিনী সমন্বয় করে দায়িত্ব পালন করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। এরপর আমরা আর্মির অপারেশন কন্ট্রোল রুমে যাই। সেখানে ঢাকা শহরের প্রবেশমুখে ফোর্স মোতায়েন করে কাঠোর অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। মিটিং শেষে রাত সাড়ে ১২টায় আমরা চলে যাই।
জবানবন্দিতে আবদুল্লাহ আল-মামুন আরও বলেন, ৫ আগস্ট সকালে আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টারে নিজের দপ্তরে যাই। এর মধ্যে উত্তরা-যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন পথ দিয়ে স্রোতের মতো ছাত্র-জনতা প্রবেশ করতে থাকে। দুপুর ১২টা থেকে ১টার মধ্যে জানতে পারি ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন প্রধানমন্ত্রী। ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তিনি কোথায় যাবেন তা আমরা জানতাম না। এরপর বিকেলে আর্মির হেলিকপ্টারে করে পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে আমাকে প্রথমে তেজগাঁও বিমানবন্দরের হেলিপ্যাডে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্টের অফিসার্স মেসে নিয়ে যাওয়া হয়। হেলিকপ্টারে আমার সঙ্গে এসবিপ্রধান মনিরুল, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিব ও ডিআইজি আমেনা ছিলেন। পরের ধাপে হেলিকপ্টারে এডিশনাল ডিআইজি প্রলয়, এডিশনাল আইজি লুৎফুল কবিরসহ অন্যান্যদেরও সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়।
পুলিশের সাবেক প্রধান আরও বলেন, ৬ আগস্ট আইজিপি হিসেবে তাঁর নিয়োগ চুক্তি বাতিল করা হয়। ক্যান্টনমেন্টে থাকাকালে ৩ সেপ্টেম্বর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
জবানবন্দিতে গত বছরের ২৭ জুলাইয়ের বর্ণনা দেন আবদুল্লাহ আল-মামুন। বলেন, আন্দোলন চলাকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল, স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আমরা নারায়ণগঞ্জে আন্দোলনের পরিস্থিতি দেখতে যাই। যাওয়ার পথে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে আমরা কিছুক্ষণ অবস্থান করি। ওই সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মোবাইলে একটি ভিডিও দেখান ওয়ারি জোনের ডিসি ইকবাল। ভিডিও দেখিয়ে ইকবাল বলেন, ‘গুলি করি, একজন মরে, একজন আহত হয়। সেই যায়। বাকিরা যায় না।’
চৌধুরী মামুন বলেন, ১৮ জুলাই তাঁকে ফোন করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি লেথাল উইপেন (প্রাণঘাতি অস্ত্র) ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। ওই সময় আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টারে ছিলাম। আমার সঙ্গে এডিশনাল ডিআইজি প্রলয়ও ছিলেন। নির্দেশনার বিষয়টি জানানোর পর ডিএমপি কমিশনারসহ সারা দেশের পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে বার্তা পৌঁছে দেন প্রলয়। এরপর থেকেই আন্দোলন দমনে মারণাস্ত্র ব্যবহার শুরু হয়। তবে মারণাস্ত্র ব্যবহারে অতি উৎসাহী ছিলেন হাবিব ও ডিবির হারুন। মূলত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশনা ছিল যেকোনভাবে আন্দোলন দমাতে হবে। এছাড়া প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারে প্রধানমন্ত্রীকে প্ররোচিত করেন কামাল, আনিসুল, ফজলে নূর তাপস, সালমান এফ রহমান, ওবায়দুল কাদের, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, মির্জা আযম, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেননসহ কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা।
পুলিশের এই সাবেক প্রধান বলেন, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতাকর্মী ছাড়াও আন্দোলন দমনে সরকারকে উৎসাহিত করেন আওয়ামীপন্থি বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী ও ব্যবসায়ীরা।
ট্রাইব্যুনালে এদিন প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এমএইচ তামিম। জেরার জন্য বুধবার দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। বেলা পৌনে ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সাবেক আইজিপি মামুনের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।
বাঁধন/সিইচা/সাএ
সর্বশেষ খবর
জাতীয় এর সর্বশেষ খবর