
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য এয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন সরব হলেও, খাগড়াছড়ি-২৯৮ নং সংসদীয় আসনটি কৌতূহল ও উত্তেজনার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের এই আসনটি ভৌগোলিক, জাতিগত, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত কারণে বরাবরই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। এখানে নির্বাচনী লড়াই শুধু কাগজে-কলমে নয়, বরং জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতির সংঘর্ষ, উন্নয়ন ও বঞ্চনার বিতর্ক, অস্ত্র উদ্ধার, শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন ও প্রতিশ্রুতির হিসাব-নিকাশের এক বড় মঞ্চ। জাতীয় রাজনৈতিক এজেন্ডার বাইরে প্রায়শই এখানের নির্বাচনে পাহাড়ি-বাঙালি ইস্যু মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
খাগড়াছড়ি জেলার ৯টি উপজেলা ও ৩টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত এই আসনে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী মোট নিবন্ধিত ভোটার ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৭২৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২,৭৬,০৫৮ জন এবং নারী ভোটার ২,৬৯,৬৬৫ জন। প্রায় ২৭ হাজারের বেশি নতুন ভোটার প্রতিনিয়ত অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে এই সংখ্যা পরিবর্তিত হচ্ছে।
খাগড়াছড়ি আসনে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো বরাবরই জাতীয় দলগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ইউপিডিএফ ও জেএসএস-এর মতো দলগুলো তাদের সাংগঠনিক কাঠামো ও জাতিগত ভিত্তিকে ব্যবহার করে। পাহাড়ে নির্বাচন সবসময়ই কিছুটা উত্তেজনার জন্ম দেয়। অস্ত্রধারী গোষ্ঠী, আধিপত্য বিস্তার ও রাজনৈতিক সংঘাতের শঙ্কা থেকেই যায়, যা নির্বাচন কমিশনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
এবারের নির্বাচনে তিনটি শক্তিশালী পক্ষকে ঘিরে প্রতিযোগিতা হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে: ১। জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিএনপি প্রার্থী, ২। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এনসিপি, গণ অধিকার পরিষদসহ অন্যান্যদের সমন্বয়ে ঐক্য প্রার্থী, ৩। আঞ্চলিক সংগঠন ইউপিডিএফ ও জেএসএস-এর পৃথক পৃথক প্রার্থী।
ভোটে প্রার্থীদের পরিচয় অনেক সময় জাতিগত বিভাজন তৈরি করে। বাঙালি ভোটের একটি বড় অংশ জাতীয় দলগুলোর দিকে ঝুঁকে থাকে, আর পাহাড়ি ভোট বিভক্ত হয় আঞ্চলিক দলগুলোর মাঝে। যা আসন্ন নির্বাচনেও পাহাড়ে সহিংসতা, দখল-পাল্টা দখল, হুমকি ও অস্ত্রধারী গোষ্ঠীর কার্যক্রম, নির্বাচন কমিশন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
২৪ পরবর্তী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারাদেশের ন্যায় খাগড়াছড়িও এখন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বশূন্য। বিএনপি অতীতে এ আসনে শক্ত অবস্থানে ছিল এবং বর্তমানেও তা ধরে রেখেছে। অতীতে এ আসনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপির সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ কর্মসংস্থান বিষয়ক সম্পাদক ওয়াদুদ ভূঁইয়া। আগামী নির্বাচনে আবারও লড়তে চান তিনি। দুই বারের নির্বাচিত সাবেক এই এমপি ২০০১ সালে নির্বাচনের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান হিসেবে শুধু খাগড়াছড়িই নয়, পার্বত্য অন্য দুই জেলার উন্নয়নেও ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন উপজেলায়, ইউনিয়নে দলের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে, দল গোছানোর পাশাপাশি চালাচ্ছেন জোর নির্বাচনী প্রচারণা।
এ বিষয়ে ওয়াদুদ ভূঁইয়া বলেন, "ভৌগোলিক কারণে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আসন। এ আসন থেকে আমি পূর্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির একমাত্র মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ২ বার ধানের শীষের প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছি। ২০০১-২০০৬ সাল খাগড়াছড়ির শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত পাহাড়ি দুর্গম এলাকার আনাচে-কানাচে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছি। রাস্তাঘাট, কালভার্ট, ব্রিজ মসজিদ-মাদ্রাসা, মন্দির-প্যাগোডা, কিয়াংয়ে এখনো আমার উন্নয়নের ছাপ স্পষ্ট। ফ্যাসিবাদী সৈরাচারী আওয়ামী সরকার আমার কাজগুলোকেই ঘষেমেজে তাদের উন্নয়ন বলে প্রচার করতো। ২০০১ সালে উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান মনোনীত হওয়ার পর ৩ পার্বত্য জেলাকেই সমানভাবে উন্নয়নের আওতায় এনেছি। বিশেষ করে পাহাড়ে কৃষি খাতে আম্রপালি আম, মাল্টা আমার হাতেই যাত্রা শুরু। সাজেক পর্যটন উন্নয়নে সর্বাধিক অবদান রয়েছে আমার। জনগণের প্রতি আমার দৃঢ় বিশ্বাস এবং আস্থা রয়েছে যে, আগামীতে যদি দল আমাকে মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন প্রদান করে আর যদি জনগণ আমাকে নির্বাচিত করে তাহলে ইনশাআল্লাহ খাগড়াছড়ির সকল সেক্টর থেকে প্রথমে দুর্নীতি দূর করব। শিক্ষার প্রসারে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন, পর্যটন, কৃষি খাতের উন্নয়নে স্থানীয় কৃষি হিমাগার স্থাপন, সড়ক উন্নয়ন এবং পাহাড়ে শান্তি স্থাপনে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, সমঝোতা, আস্থা-বিশ্বস্ততার মাধ্যমে পারস্পরিক সম্প্রীতির শান্তি প্রতিষ্ঠা সহ সকল সেক্টরেই কাজ করব।"
এছাড়াও খাগড়াছড়ি আসনে ইতোমধ্যেই প্রথমবারের মতো দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। জামায়াতে ইসলামী থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গার বাসিন্দা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও কুমিল্লা মহানগর জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট ইয়াকুব আলী চৌধুরী এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন দলটির জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাওলানা কাওসার আজিজী। দল দুটির নেতৃবৃন্দ জেলা-উপজেলাগুলোতে নিয়মিত সভা-সমাবেশ, শোডাউনসহ বিভিন্নভাবে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ আসনে জয়ী হওয়ার আশাবাদী অ্যাডভোকেট ইয়াকুব আলী চৌধুরী। তিনি বলেন, "২৪ পরবর্তী সারাদেশের মতো খাগড়াছড়ির প্রেক্ষাপটও ভিন্ন। এখানে মানুষ শান্তি-সম্প্রীতি চায়। নতুন প্রজন্ম অনেক সচেতন যা ডাকসুর নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে। এ আসন থেকে আমি যদি নির্বাচিত হই তাহলে এখানে আমার প্রথম কাজ হবে খাগড়াছড়িকে দুর্নীতিমুক্ত করা। সে সাথে শিক্ষার উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, কৃষি, পর্যটন, সাম্প্রদায়িক বন্ধন অটুট রাখতে যা যা করা দরকার সবটাই করব ইনশাআল্লাহ।"
এছাড়াও প্রার্থী দিতে পারে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও নুরের গণ অধিকার পরিষদ। আলোচনায় রয়েছে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক ও জেএসএস সংস্কারও। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) দলীয়ভাবে খাগড়াছড়িতে এখনো কাউকে প্রার্থী ঘোষণা করেনি। তবে আলোচনায় আছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠক অ্যাডভোকেট মনজিলা ঝুমা।
জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) থেকে নির্বাচনে লড়তে পারেন সভাপতি বিমল কান্তি চাকমা। দলটির প্রচার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত জুপিটার চাকমা বলেন, "নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে নির্বাচন নিয়ে আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে।"
পার্বত্য চুক্তি বিরোধী আঞ্চলিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) স্বায়ত্বশাসনের দাবি নিয়ে প্রতিবারই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। এই সংগঠনের নামে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিযুক্ত হলেও এই সংগঠনটি এখনো খাগড়াছড়ির রাজনীতির প্রধান ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইউপিডিএফ ও জেএসএস ভিন্ন আদর্শে বিশ্বাসী হলেও, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর একাংশের সমর্থন তাদের পক্ষে। এদের মধ্যে ইউপিডিএফ নির্বাচনে স্বাধীনভাবে অংশ নিলেও, অতীতে কখনো কখনো ভোট বর্জনের পক্ষেও অবস্থান নিয়েছে।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছে সংগঠনটি। ইউপিডিএফ এর মুখপাত্র অংগ্য মারমা বলেন, "পার্বত্য চট্টগ্রামের নির্বাচন ব্যবস্থা সারাদেশের চেয়ে ভিন্ন। এখানে পাহাড়ি-বাঙালি একটি সাম্প্রদায়িক ইস্যু সবসময় কাজ করে। আর তার পিছনে একটি অদৃশ্য শক্তি কাজ করছে। তবে আমরা নির্বাচনে ভোট গ্রহণের সুষ্ঠু পরিবেশ চাই। এখানকার সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে ইউপিডিএফ। সুষ্ঠু পরিবেশ না পেলে নির্বাচন বর্জন করার সিদ্ধান্তও আসতে পারে।"
সর্বশেষ খবর