
রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে ও ডলারের সংকট নিরসন এবং সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় অধিকতর স্বচ্ছতার জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করে আসছে সরকার। অবশ্য নিরুৎসাহিত করা সরকারি পরিপত্র প্রতিপালনের উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত দেখাতে পারছেন না সরকারি কর্মকর্তারা। পাশাপাশি ভ্রমণ বিলাসের বৈধতা দিতে বিদেশ ভ্রমণের শর্ত রেখেই চুক্তি করা হচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি বিভাগের কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে জন্য যেমন রয়েছে চীনভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে টেকনোলজিস তেমন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এর কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে জন্য রয়েছে দেশি প্রতিষ্ঠান স্টার টেক অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড।
১৪ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত “ডেটা সেন্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রিপোর্টিং” শীর্ষক একটি প্রশিক্ষণে অংশ নেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কয়েকজন কর্মকর্তা। এই সফর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা থাকা জাতিয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মোহাম্মদ বেলাল হোসেন চৌধুরীসহ অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের মোট ১১ জন কর্মকর্তা প্রশিক্ষণের জন্য ইন্দোনেশিয়া সফরে যান। তবে এই সরকারি সফরের সম্পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করে স্টার টেক অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড নামের একটি বেসরকারি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান।
উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এই স্টার টেক লিমিটেডের বিরুদ্ধেই মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে স্বয়ং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) একটি তদন্ত পরিচালনা করছে। তদন্তাধীন একটি প্রতিষ্ঠানের অর্থে এনবিআরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণের অনুমোদন পাওয়ায় এটি সরাসরি স্বার্থের সংঘাত (Conflict of Interest) বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্টার টেক লিমিটেডের বিরুদ্ধেই নকল প্রযুক্তিপণ্য বিক্রিসহ লন্ডারিং ও বাজারে মনোপলি তৈরি করে অধিক দামে প্রযুক্তিপণ্য বিক্রির অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, স্টার টেকের চেয়ারম্যান মো. রাশেদ আলী ভূঁইয়া বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
সরকারি কোনো কর্মকর্তা ঠিকাদার বা বেসরকারি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের অর্থে বিদেশ ভ্রমণ করতে পারবেন না। গত ২৩ মার্চ এ-সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সিনিয়র সচিব ও সচিবকে চিঠি পাঠিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। এ বিষয়টি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, ঠিকাদার ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে কর্মকর্তাদের অবশ্যই বিদেশ ভ্রমণ পরিহার করতে হবে। পাশাপাশি জরুরি কারণ ছাড়া উপদেষ্টা বা সিনিয়র সচিব ও সচিবদের একান্ত সচিব বা সহকারী একান্ত সচিবদের সহযাত্রী হিসেবে বিদেশে ভ্রমণ পরিহার করতে হবে।
বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা কয়েক মাস যাবৎ লক্ষ্য করছি যে, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা প্রযুক্তি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সমূহের নিজস্ব অর্থায়নে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণ অব্যাহত রয়েছে। যার সম্পূর্ণভাবেই নীতি বহির্ভূত কাজ এবং অপরাধ জনক কর্মকান্ড। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে যে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী বিদেশ ভ্রমণ করছেন তাদের ব্যাপারে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আর ভবিষ্যতে সরকারি কোন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এমন কি সরকারের উপদেষ্টা থেকে শুরু করে একজন পিয়ন বা ড্রাইভার পর্যন্ত যাতে বিদেশ সফর না করতে পারে এই বিধি-বিধান নিশ্চিত করতে হবে। ইতিপূর্বে যারা গিয়েছেন এবং রাজস্ব বিভাগের যে সকল কর্মকর্তা বিদেশে যেতে চাচ্ছেন তাদের ব্যাপারে একটি তদন্ত হোক। সরকারের যদি প্রয়োজন হয় তাদের উচ্চতার প্রশিক্ষণের তাহলে রাষ্ট্রীয় অর্থায়নেই তাদের বিদেশ ভ্রমণ নিশ্চিত করা হোক। কিন্তু দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান দিয়ে বিদেশ ভ্রমণ এর উদ্দেশ্য হচ্ছে দুর্নীতি প্রশমিত করা। যারা দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে বিদেশ যাচ্ছেন আমরা মনে করি এই প্রতিষ্ঠান এবং এ সকল কর্মকর্তা কর্মচারী উভয়েই শাস্তির যোগ্য অপরাধ করেছেন।
সরকারি কর্মকর্তাদের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে বিদেশ ভ্রমণে মূলত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কর্মকর্তাদের বিনোদনমূলক উপহার। সরকারি কর্মকর্তাদের ভ্রমণের পেছনে ব্যয় করা অর্থ আমাদের কাছ থেকেই মুনাফা হিসেবে আদায় করে নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। ক্রয় প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা (ঠিকাদারদের সাথে) পরস্পর যোগসাজশে চুক্তিতে এসব শর্ত দেয়। এতে প্রকল্পের টাকা যেমন লুটপাত হয় তেমনি বিদেশ সফর বাবদ কর্মকর্তাদের আয় হয়।
রার/সা.এ
সর্বশেষ খবর