
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির শফিকুর কবির অডিটোরিয়ামে আজ বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক), বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এবং কোয়ালিশন ফর দ্য আরবান পুয়র (কাপ)-এর উদ্যোগে জলবায়ু সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত নগর বস্তিবাসীদের আবাসন সমস্যা সমাধানে একটি জাতীয় জনসংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
অনুষ্ঠানে ধারণাপত্র পাঠ করেন বারসিক-এর সমন্বয়ক ও নগর গবেষক মো. জাহাঙ্গীর আলম। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিআইপি-এর সভাপতি অধ্যাপক আদিল মোহাম্মদ খান। জনসংলাপে সভাপতিত্ব করেন কোয়ালিশন ফর দ্য আরবান পুয়র (কাপ)-এর নির্বাহী পরিচালক খোন্দকার রেবেকা সান-ইয়াত। এছাড়াও সংলাপে হেনা আক্তার রুপাসহ বিভিন্ন সংগঠনের অন্যান্য কর্মকর্তা ও নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
সংলাপে জানানো হয়, ঢাকার আয়তন ৩০৬ বর্গকিলোমিটার এবং ২০২২ সালের শুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যা ২ কোটি ১০ লক্ষ। এই জনসংখ্যার প্রায় ৫০ লক্ষেরও অধিক মানুষ বস্তিতে বসবাস করে। জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এই বস্তিবাসীদের অধিকাংশই সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, আগাম বন্যা, অতিবন্যা, লবণাক্ততা, খরা, পাহাড়ধস ইত্যাদি জলবায়ু সংকটের কারণে উদ্বাস্তু হয়ে গ্রাম থেকে শহরে আসতে বাধ্য হয়েছে। জলবায়ু সংকটের কারণে এই শহরমুখী প্রবণতা দিন দিন আরও প্রকট আকার ধারণ করছে। সব কিছু হারিয়ে শহরে এসেও তারা বস্তি, ঝুপড়ি এবং পথবাসী হয়ে জলবায়ুর নানাবিধ সংকটের মধ্যে অমানবিক জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।
নগরে জলবায়ু সংকটের মধ্যে রয়েছে খরা, তাপদাহ, বন্যা, জলাবদ্ধতা, শৈত্যপ্রবাহ ইত্যাদি। ঢাকার বস্তির অধিকাংশ ঘর টিন, বাঁশ, সেমিপাকা, পলিথিন দ্বারা তৈরি। ফলে তাদের আবাসন উপকরণ ও স্থানের কারণে তারা গ্রীষ্মকালে খরা ও তাপদাহ, বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা ও বন্যা এবং শীতকালে শৈত্যপ্রবাহের শিকার হয়, যা তাদের জীবন-জীবিকাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে।
বস্তিবাসীদের প্রধান পেশা হলো রিকশা ও ভ্যান চালানো, গৃহকর্মী, মাটি কাটা, ইট ভাঙা, রাজমিস্ত্রি, রংমিস্ত্রি, ট্রাকের হেলপার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ, টেম্পো, ট্রাক, বাস, প্রাইভেট কার এবং সিএনজি চালানো, গার্মেন্টসে চাকরি, ক্ষুদ্র ব্যবসা, হকারি, দারোয়ান, ভিক্ষাবৃত্তি ইত্যাদি অনানুষ্ঠানিক পেশা। এই সব পেশায় যে আয় হয় তা দিয়ে তাদের সংসার চালানো খুব কঠিন। নগরে তাদের ঘরের অবস্থা ও সুবিধা বিবেচনায় তারা সবচেয়ে বেশি ভাড়া প্রদান করেন। পাশাপাশি তারা পানি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পয়োনিষ্কাশন সুবিধা সীমিত হলেও এই সবের জন্য সবচেয়ে বেশি টাকা দিতে বাধ্য হন। একে রাষ্ট্রের একটি অন্যায্য ব্যবস্থা হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়, এটি বন্ধ করে সবার জন্য একটি ন্যায্য ও সমতাভিত্তিক নগর তৈরি করা জরুরি।
জাতিসংঘের ক্লাইমেট সেন্টারের সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, গত বছর এপ্রিল ছিল বিগত ৭৬ বছরের মধ্যে উষ্ণতম মাস এবং ঢাকায় ঝুঁকিপূর্ণ তাপমাত্রা ছিল ৫২ দিন। বাংলাদেশে তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকায় গত বছর অন্তত ২৫ কোটি কর্মদিবস নষ্ট হয়েছে, যা ২১ হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি ডেকে এনেছে। রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে দিন দিন তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে। ঢাকার তাপমাত্রা জাতীয় গড় তাপমাত্রার চেয়ে প্রায় ৬৫ শতাংশ বেশি। জলবায়ু সংকটের কারণে যে সময়ের এবং টাকার অপচয় হয়েছে তার অধিকাংশ অপচয়ই হয়েছে নগরের বস্তিবাসী মানুষদের। যেহেতু তাদের অধিকাংশ মানুষই খোলা স্থানে কাজ করেন, ফলে জলবায়ু সংকটের কারণে তাদের ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীতকাল বস্তিবাসী মানুষের জন্য এক একটি অভিঘাতের নাম। গরমকালে টিনের ঘরে বাস করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে যায় এবং তারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন। ফলে তাদের আয় কমার পাশাপাশি চিকিৎসার জন্য আয়ের একটি বড় অংশ খরচ হয়ে যায়। বর্ষাকালে বৃষ্টি হলেই অধিকাংশ স্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে ঘরে ময়লাযুক্ত পানি ঢোকে এবং পরিবারের আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে যায়।
বারসিক-এর গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বর্ষাকালে ঘরে পানি ওঠার কারণে প্রতি পরিবারের গড়ে ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকার সম্পদ নষ্ট হয়ে যায়। এই সময়ে তারা জ্বর, কাশি, চুলকানি, ঠান্ডা, গা ব্যথা, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, গ্যাস্ট্রিক, হাঁপানি, ডায়রিয়া, কলেরা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগে আক্রান্ত হন এবং তাদের আয়ের অধিকাংশ টাকা চিকিৎসা বাবদ খরচ হয়। বারসিক-এর গবেষণায় আরও দেখা গিয়েছে, এই বছর বস্তিবাসী মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে সবচেয়ে বেশি ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন এবং চিকিৎসা বাবদ রোগী প্রতি গড়ে ৬০০০-৮০০০ টাকা খরচ হয়েছে। এই সংকট দিন দিন বাড়তেই থাকবে। নগরের বস্তিবাসীদের বাঁচাতে হলে তাদের জন্য উপযুক্ত আবাসন নিশ্চিত করা জরুরি।
সংলাপে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নীতিমালা ও সরকারের দায়হীন আচরণের সমালোচনা করে বলা হয়, এই নগরে ধনী-গরিবের বৈষম্য সীমাহীন। বৈষম্যহীন দেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে গত বছর হাজারেরও অধিক মানুষের প্রাণের বিনিময়ে দেশে জুলাই ছাত্র আন্দোলন হলেও, নগর দরিদ্রদের ভাগ্য পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা এখনও দৃশ্যমান নয়। জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি)-এ বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যমুক্ত, ক্ষুধামুক্ত, গৃহহীনমুক্ত, জলবায়ু সহনশীল নগর তৈরি করা হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংকটের কারণে এবং সেবা-পরিসেবাপ্রদান, নীতিমালা তৈরি ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নগর দরিদ্রদের কথা সেইভাবে বিবেচনায় রাখা হয় না। যেকোনো পরিকল্পনায় দরিদ্র মানুষদের কেন্দ্রে রেখে পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন করলে এই সংকট দ্রুতই দূর হয়ে যেত। ওয়ার্ল্ড আরবান ফোরামের মূল কথা হলো 'সবার জন্য নগর, সবাইকে নিয়েই নগর'। সুতরাং নগরের বস্তিবাসীসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয়ভাবেই করতে হবে।
জনসংলাপ থেকে নগর দরিদ্র বস্তিবাসীদের কিছু দাবি উত্থাপন করা হয়:
১) নগর দরিদ্রদের জন্য নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব ও জলবায়ু সহনশীল আবাসন তৈরি করে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের প্রদান করতে হবে।
২) বস্তিবাসীদের জন্য পর্যাপ্ত পানি, পয়োনিষ্কাশন, বিদ্যুৎ, জ্বালানিসেবা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা সরকারি ভর্তুকিতে প্রদান করতে হবে।
৩) সরকারি সকল ধরনের সেবা-পরিসেবা নগরের বস্তিবাসী মানুষদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে।
৪) নগরকে জলবায়ু সহনশীল নগর হিসেবে তৈরি করার জন্য সব পেশার মানুষদের নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে।
৫) নগর দরিদ্রদের জন্য বিনামূল্যে বিশেষ কারিগরি ও ব্যবহারিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
৬) তাদের জন্য ভর্তুকি মূল্যে সারা বছর পণ্য কেনার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর
জাতীয় এর সর্বশেষ খবর