দুইশ আটত্রিশটি আসনে একক প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। ঘোষণার পর থেকেই দলীয় প্রার্থীরা মাঠে নেমে পড়েছেন, শুরু করেছেন গণসংযোগ ও প্রচারণা। তবে প্রার্থী তালিকা ঘিরে ইতিমধ্যে দলে দেখা দিয়েছে অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন। অনেক জায়গায় বিক্ষোভ, মানববন্ধন, এমনকি সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। মনোনয়নবঞ্চিতদের কেউ কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন।
দলীয় সূত্র বলছে, ঘোষিত আসনের মধ্যে অন্তত ২৩টিতে তীব্র বিরোধ তৈরি হয়েছে। এসব আসনে মনোনয়নবঞ্চিত প্রভাবশালী নেতারা শক্ত অবস্থানে রয়েছেন। তারা দাবি তুলেছেন প্রার্থী পুনর্মূল্যায়নের। বিএনপির নির্বাচনসংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল নেতাদের তদন্তেও এই তথ্য উঠে এসেছে।
পর্যবেক্ষণে দল, প্রার্থী পরিবর্তনের ইঙ্গিত
বিএনপির হাইকমান্ড মনোনীত প্রার্থীদের মাঠপর্যায়ের কর্মকাণ্ড গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। বিশেষ করে মনোনয়নবঞ্চিত ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের সঙ্গে প্রার্থীরা কেমন আচরণ করছেন, তা যাচাই করা হচ্ছে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান দিয়ে। যাচাই-বাছাই শেষে প্রার্থী তালিকায় পরিবর্তন আসতে পারে বলে জানিয়েছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, “কয়েকটি আসনে ক্ষোভ হতেই পারে। এসব আমরা ভালোভাবে হ্যান্ডল করছি। ফাঁকা সব আসন মিত্রদের জন্য রাখা হবে না; কিছু আসনে শিগগিরই দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করা হবে।”
দলীয় সূত্র আরও জানায়, যারা মনোনয়ন পেয়েছেন, তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বঞ্চিতদের মানভাঙিয়ে ঐক্য গঠনের। কেউ যদি এতে ব্যর্থ হন বা ঐক্য তৈরিতে বাধা দেন, তাহলে ধানের শীষের স্বার্থে প্রার্থী পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে হাইকমান্ড।
২৩ আসনে তীব্র বিরোধ ও বিক্ষোভ
ঘোষিত তালিকার পর থেকেই অন্তত ২৩টি আসনে ব্যাপক ক্ষোভ ও প্রতিবাদ শুরু হয়। সাতক্ষীরা, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, নাটোর, নারায়ণগঞ্জ, মেহেরপুর, রংপুর, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও মশাল মিছিল হয়েছে। কোথাও কোথাও সংঘর্ষেও জড়িয়েছে নেতাকর্মীরা।
সাতক্ষীরা-২ (সদর-দেবহাটা): প্রার্থী আবদুর রউফের মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে আবেদন করেছেন সদর উপজেলার ১২ ইউনিয়নের ৩৩ জন নেতা। তারা ত্যাগী নেতা আব্দুল আলিমকে প্রার্থী করার দাবি তুলেছেন।
সাতক্ষীরা-৩ (কালীগঞ্জ-আশাশুনি): ডা. শহিদুল আলমকে মনোনয়ন না দিয়ে কাজী আলাউদ্দীনকে প্রার্থী করায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে স্থানীয় বিএনপি।
ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর): প্রার্থী এম ইকবাল হোসেন ও মনোনয়নবঞ্চিত আহম্মেদ তায়েবুর রহমানের সমর্থকদের সংঘর্ষে আহত হয়েছেন অন্তত আটজন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ (নবীনগর) ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (আখাউড়া-কসবা) আসনে প্রার্থী পুনর্বিবেচনার দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ।
সিলেট-৪ (গোয়াইনঘাট-জৈন্তাপুর-কোম্পানীগঞ্জ): আবদুল হাকিম চৌধুরীকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবিতে হাজারো নেতাকর্মীর মশাল মিছিল।
ময়মনসিংহ-৬ (ফুলবাড়িয়া): স্থানীয়রা আখতারুল আলমের পরিবর্তে আব্দুল করীম সরকারকে প্রার্থী করার দাবিতে বিক্ষোভ।
হবিগঞ্জ-৪ (চুনারুঘাট-মাধবপুর): ছাত্রদল নেতাকর্মীদের দাবি—এসএম ফয়সালের পরিবর্তে শাম্মী আক্তারকে মনোনয়ন দেওয়া হোক।
রংপুর-৩: মহানগর আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামুর মনোনয়নের বিরুদ্ধে গণমিছিল করেছে মাহফুজ উন নবীর সমর্থকরা।
কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ): শাহজাহান চৌধুরীর পরিবর্তে আবদুল্লাহকে প্রার্থী করার দাবিতে বিক্ষোভ।
নাটোর-১ (লালপুর-বাঘাতিপাড়া): প্রয়াত ফজলুর রহমান পটলের মেয়ে ফারজানা শারমিন পুতুলকে প্রার্থী করায় ত্যাগী নেতা তাইফুল ইসলাম টিপু ও ইয়াছির আরশাদের সমর্থকদের বিক্ষোভ।
নারায়ণগঞ্জ-২ (আড়াইহাজার): মনোনয়নবঞ্চিত কেন্দ্রীয় নেতারা একমঞ্চে এসে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি তুলেছেন।
মেহেরপুর-২ (গাংনী): প্রার্থী আমজাদ হোসেনের পরিবর্তে জেলা সভাপতি জাভেদ মাসুদকে প্রার্থী করার দাবিতে আন্দোলন চলছে।
চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড): বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আসলাম চৌধুরীকে মনোনয়ন না দেওয়ায় বিক্ষোভ।
চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি): কর্নেল (অব.) আজিম উল্লাহ বাহারকে মনোনয়ন না দেওয়ায় সড়কে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ।
নরসিংদী-৪, মুন্সীগঞ্জ-২, ঠাকুরগাঁও-৩, নোয়াখালী-৫, রাজশাহী-৪ ও ৫— এসব আসনেও মনোনয়ন নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে।
স্বতন্ত্র প্রার্থিতার আশঙ্কা
বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মতে, কিছু মনোনয়নবঞ্চিত নেতা ইতোমধ্যেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বড় একটি রাজনৈতিক দলও তাদের প্রার্থী করতে আগ্রহী বলে জানা গেছে। এতে ভোট বিভাজনের আশঙ্কা থাকায় দলীয় প্রার্থী তালিকা পুনর্বিবেচনার চিন্তাভাবনা করছে বিএনপি হাইকমান্ড।
মিত্রদের জন্য আসন ছাড় ও নতুন প্রার্থী ঘোষণা আসছে
ঘোষিত ২৩৭ আসনের বাইরে ৬৩টি আসন এখনো ফাঁকা রাখা হয়েছে। বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, এসব আসনের মধ্যে অন্তত ১১ আসনে শিগগিরই একক প্রার্থী ঘোষণা করা হবে। সম্ভাব্য আসনগুলোর মধ্যে রয়েছে—
ঢাকা-৯, ঢাকা-১৮, ঢাকা-২০, মাদারীপুর-২, গাজীপুর-১, টাঙ্গাইল-৫, চট্টগ্রাম-৬, চট্টগ্রাম-৯, চট্টগ্রাম-১১, ঝিনাইদহ-৪ ও সিরাজগঞ্জ-১।
অন্যদিকে বাকি আসনগুলোর বেশির ভাগ মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য ছেড়ে দেওয়া হতে পারে। এ বিষয়ে চলতি মাসের শেষ দিকে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে শরিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
দলের অবস্থান স্পষ্ট
৩ নভেম্বর গুলশানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্ভাব্য ২৩৭ আসনের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেন। তিনি তখনই বলেন, “এটি চূড়ান্ত তালিকা নয়। যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে কোনো কোনো আসনে পরিবর্তন আনা হতে পারে।”
দলীয় নেতাদের ভাষায়, প্রার্থী নির্বাচনে বিএনপি এবার সতর্ক এবং বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে চায়। “ধানের শীষের বিজয়ের স্বার্থে প্রয়োজন হলে মনোনয়ন পরিবর্তনেও দ্বিধা করবে না,” বলছেন নীতিনির্ধারকরা।
সাজু/নিএ
সর্বশেষ খবর
রাজনীতি এর সর্বশেষ খবর