বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) শীর্ষ নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তব্যে নানা ধরনের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি উঠে এসেছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মানবাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, স্বাধীন গণমাধ্যম ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের অঙ্গীকার করেন। অন্যদিকে স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ দল পুনর্গঠন, স্বচ্ছতা বৃদ্ধি ও দমন-পীড়নের বিচার নিশ্চিত করার কথা বলেন।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন নির্ভর করছে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, প্রশাসনিক সংস্কার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও আর্থিক সক্ষমতার ওপর। অনেক প্রতিশ্রুতি বাস্তবসম্মত হলেও গভীর কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়া পূরণ করা কঠিন হবে বলে তারা মনে করেন।
বিএনপি ক্ষমতায় গেলে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেছেন, শিক্ষা হলো এমন একটি শক্তি, যা প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব। নেলসন ম্যান্ডেলার শিক্ষাবিষয়ক বক্তব্য উদ্ধৃত করে তিনি জানান, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হলো মানসম্মত শিক্ষা।
বিশ্ব খাদ্য দিবস উপলক্ষে কৃষকদের প্রতি নতুন করে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, দেশের কৃষকই বাংলাদেশের প্রকৃত শক্তি। বগুড়ার উর্বর জমি থেকে শুরু করে বরিশালের ভাসমান বাগান—প্রতিটি শস্যদানা কৃষকের সহনশীলতা, ত্যাগ ও পরিশ্রমের সাক্ষী। কৃষকদের অবদান দিয়েই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্মিত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বেসরকারি শিক্ষকদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিএনপি নীতিগতভাবে তাদের পাশে আছে বলে জানান তারেক রহমান। তিনি বলেন, রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে সরকারের সামর্থ্য অনুযায়ী বেসরকারি শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবি পূরণ করা হবে এবং শিক্ষাখাতে বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।
স্বাস্থ্যখাতে বিশেষ উদ্যোগের কথাও তুলে ধরেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ক্ষমতায় গেলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ‘হেলথ কেয়ার’ নামে একটি বিশেষ টিম গঠন করা হবে। পাশাপাশি দেশের সব নাগরিককে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনতে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করা হবে। পরিবারের মায়েদের স্বনির্ভরতা বাড়াতে চালু করা হবে পরিবারভিত্তিক ‘ফ্যামিলি কার্ড’।
নারীর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, দেশের মেয়েরা, মায়েরা ও বোনেরা ভয় নিয়ে বাঁচতে পারে না। কথা বলা, কাজ করা, পড়াশোনা বা স্বাধীনভাবে চলাফেরার মতো মৌলিক কর্মকাণ্ডেই যখন নারীরা হয়রানি, হুমকি ও সহিংসতার শিকার হন, তখন তা জাতির ভবিষ্যৎকে অন্ধকার করে দেয়। এটি বাংলাদেশের স্বপ্ন নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। অনলাইনে ও অফলাইনে, ঘরে ও বাইরে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে বিএনপির পরিকল্পিত পাঁচটি জরুরি অগ্রাধিকার বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, নারীদের নিরাপদ বোধ করানোই হবে দলের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য, কারণ নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে দেশ এগোতে পারে না।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও মানবাধিকার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ক্ষমতায় গেলে দলটি স্বাধীন গণমাধ্যম গড়ে তুলবে এবং বর্তমান ব্যবস্থার তুলনায় সাংবাদিকদের কাজের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।
ফখরুল বলেন, মানবাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে সরকারের এক অঙ্গীকারমূলে। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা হবে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ ও হয়রানি কমানো হবে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হবে, যাতে রাজনৈতিক দলগুলো সমান সুযোগ পায় এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও ন্যায্য হয়। ক্ষমতায় এলে সরকার সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে, যাতে সকল সরকারি ও স্থানীয় সংস্থা জনগণের কাছে দায়িত্বশীল থাকে।
এদিকে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সম্প্রতি ধর্মীয় ও সাংবিধানিক বিষয়ে একাধিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ২৩ নভেম্বর রাজধানীতে ইমাম খতিব পরিষদের জাতীয় সম্মেলনে তিনি বলেন, কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন করা হবে না; এমন আইন থাকলে তা বাতিল করা হবে।
অন্যদিকে ১৫ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খতমে নবুওয়ত মহাসম্মেলনে অংশ নিয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ জানান, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সংবিধানে ‘মহান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনর্বহাল করা হবে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়ে এ বাক্যটি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ও প্রস্তাবনায় ছিল, যা পরবর্তীতে বাদ দেওয়া হয়। বিএনপি নতুন সরকার গঠনের সুযোগ পেলে তা পুনরায় যুক্ত করা হবে।
ধর্মীয় শিক্ষার উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ধর্মীয় শিক্ষকের নতুন পদ সৃষ্টি করা হবে। মুসলিম-প্রধান দেশে নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ জোরদারের লক্ষ্যে এসব পদে নিয়োগ দেওয়া হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বিএনপি নেতৃত্বের এসব বক্তব্যে দলটির রাজনৈতিক, সাংবিধানিক ও ধর্মীয় এজেন্ডাকে পুনরায় জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তবে দল ক্ষমতায় গেলে নেতাদের এসকল প্রতিশ্রুতি কতটুকু বাস্তবায়নযোগ্য হবে সেটাই দেখার বিষয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকগণ।
সাজু/নিএ
সর্বশেষ খবর
এক্সক্লুসিভ এর সর্বশেষ খবর