মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া এবং সদর উপজেলার আটটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত মানিকগঞ্জ-৩ আসন। মানিকগঞ্জ পৌরসভা এবং জেলা শহরটি এই আসনটিতে থাকায় ভৌগোলিকভাবে আসনটির গুরুত্ব সর্বাধিক। জেলা রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু এবং মাঠ পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কর্মকাণ্ডের নির্দেশিকা চলে এই শহর থেকেই। এজন্যই যেকোনো দলের প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই আসনটিকে নিয়ে একাধিকবার ভাবতে হয়। আগামী সংসদ নির্বাচনে এই আসনটিতে জাতীয়তাবাদী দল থেকে আফরোজা খানম রিতাকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য ও মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির আহবায়ক।
আসনটিতে আরো তিনজন ছিলেন মনোনয়ন প্রত্যাশী। তাঁরা– জেলা বিএনপির সাবেক জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট জামিলুর রশিদ খান, সদর উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি আতাউর রহমান আতা, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোতালেব হোসেন।
মনোনয়ন প্রত্যাশীদের দুজন দলীয় সিদ্ধান্তে আফরোজা খানম রিতার পক্ষে মৌন সমর্থন জানালেও আতাউর রহমান আতা মোটরসাইকেল শোডাউন এবং জনসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। এই কর্মকাণ্ড দলীয় নেতৃবৃন্দ এবং সাধারণ ভোটারদের মাঝে দলীয় অনৈক্যের বহিঃপ্রকাশ দৃশ্যমান করছে। এর প্রভাব নির্বাচনে পরবে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।
সূত্রে জানা গেছে– আতাউর রহমান আতা ব্যক্তি ইমেজ কাজে লাগিয়ে নতুন কোন দলের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছেন। তবে এখনো পর্যন্ত বিএনপির হয়েই ভোটারদের কাছে যাচ্ছেন তিনি। এ বিষয়টি আসনটিতে নতুন শংকার জানান দিচ্ছে।
পাশাপাশি ওয়ান ইলেভেনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনি ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল (পিডিপি) বা কিংস পার্টিতে যোগদান করার বিষয়টিও নতুন করে আলোচনায় আসছে।
আতার ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সকল দলের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এখনো আসেনি। ঐ সময় পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করবেন দেখবেন বিএনপির সাথে কোন কোন দল জোটবদ্ধ হয়। সেই অংক মেলানোর পর তিনি ভিন্ন দলে যাবেন নাকি বিএনপিতে থেকে জেলা পরিষদ কিংবা উপজেলা চেয়ারম্যান পদ বাগাবেন সেই সমঝোতায় বসবেন।
এমন কর্ম কাণ্ডের খবর রাজনৈতিক অঙ্গনে ছড়ালে প্রশ্ন উঠে বিএনপির দুঃসময়ে তিনি কোথায় ছিলেন। ওয়ান ইলেভেনের পরে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের ২০০৯ এবং ২০১৪ সালে সদর উপজেলা নির্বাচনে জয়ী হয়ে টানা দুইবারের চেয়ারম্যান হিসেবে নাম লেখান আতাউর রহমান আতা।
দলের দুঃসময়ে তার এই প্রাপ্তি দলে কোন ইতিবাচক প্রভাব ফেলেনি বরঞ্চ তার কাছের লোকজনই মুখ ফিরিয়ে চলে এসেছে। হামলা-মামলা এবং অত্যাচারের শিকার নেতাকর্মীরা তার কাছ থেকে কোন ধরনের সহযোগিতা পায়নি। এরপর থেকে তার জনসমর্থন কমতে শুরু করে। তার নেতিবাচক কর্মকাণ্ড এবং ব্যক্তিগত জীবনে নানা প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকান্ডে বিএনপির কোন হেভি ওয়েট নেতা কিংবা অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা কেউই তার সাথে নেই।
২৪ এর অভ্যুত্থানে ছাত্র জনতার আন্দোলনে রাজপথে একটি দিনের জন্যও নেতাকর্মীদের সাথে কোন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করেননি আতা। ১৮ই জুলাই এবং ৪ আগস্ট মানিকগঞ্জে সর্বোচ্চ নৃশংস রূপ ধারণ করে। এ সময় আওয়ামী লীগ এবং পুলিশের হামলায় আহত হন বিএনপির শত শত নেতাকর্মী। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে শয্যা শায়ী অবস্থায় জেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দরা প্রতিনিয়ত আহতদের খোঁজখবর রাখলেও আতাউর রহমান আতাকে দেখেনি কেউ। প্রেক্ষাপট পরবর্তী সময়েও শহীদ এবং আহত পরিবারে পৌঁছায়নি তার পাঁ।
তিনি প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর মানিকগঞ্জের শিল্পাঞ্চল এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে গড়ে তোলেন শক্তপোক্ত সিন্ডিকেট 'আতা বাহিনী'। তখন থেকেই কিছু সুবিধাবাদী লোক ভিড় করে তার পাশে। এদের নিয়ে রাজনীতির মাঠে না ফিরে নতুন রূপে ভোটের মাঠে ফেরার চেষ্টা তার।
এর মাঝে দলীয় মনোনয়ন চেয়ে আলোচনায় আসার চেষ্টা করেন তিনি। সে প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে সাপ্তাহিক রুটিন প্রচারণায় তিনি ধানের শীষের হয়ে নিজের পক্ষে ভোট চাচ্ছেন। গণমাধ্যমের কাছে তিনি দলীয় সিদ্ধান্ত কিংবা নিজের অবস্থান সুনির্দিষ্ট ভাবে কখনো বলেননি। শুধু বলছেন তিনি মাঠে আছেন। স্বতন্ত্র কিংবা ভিন্ন দলের প্রার্থী হবেন কিনা সে বিষয়েও ধোঁয়াশা রেখে পথ হাটছেন তিনি।
অরাজনৈতিক এবং বিতর্কিত মানুষদের নিয়ে প্রচারণা চালিয়ে ভোটের মাঠে ধানের শীষের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছেন আতা। এখনই তার এই অতি উৎসাহী কর্মকান্ড থেকে ফেরাতে না পারলে দলকে চরম মূল্য দিতে হবে বলে মনে করছেন জেলার নেতৃবৃন্দরা।
ইংরেজ লেখক জেনিফার লিস-মার্শমেন্ট তার জনপ্রিয় গ্রন্থ 'রাজনৈতিক বিপণন: নীতি এবং প্রয়োগ' – সেখানে উল্লেখ করেন, কোনো নেতার সঙ্গে থাকা কর্মী বা সহযোগীদের যদি বিতর্কিত পরিচয় থাকে বা তারা অপরাধে জড়িত হন, তবে তা নেতার ভাবমূর্তিকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। একইভাবে, অরাজনৈতিক বা অপ্রাসঙ্গিক ব্যক্তিদের উপস্থিতি মূল রাজনৈতিক বার্তা ও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোকে আড়াল করে দেয়। এর ফলে ভোটাররা মনে করতে পারেন নেতা নিজের সক্ষমতা বা দলের শক্তির ওপর নির্ভর না করে বহিরাগত প্রভাব ব্যবহার করছেন। বিরোধীরা এসবকে নেতিবাচক প্রচারের ইস্যু হিসেবে কাজে লাগাতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
সাটুরিয়া উপজেলার গোপালপুর এলাকার বাসিন্দা বাসুদেব সাহার সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি প্রথমে দেখেন প্রার্থী স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন মনের মানুষ কি না। তাঁর ভাষায়, 'যার কাছে সহজে যাওয়া যায়, যাকে দেখে ভয় লাগে না সেই মানুষই আমাদের প্রতিনিধি হওয়ার যোগ্য।'
তিনি বলেন, 'এখন কিছু প্রার্থী এলাকায় আসেন শত শত মোটরসাইকেল নিয়ে শোডাউন করে। এতে এলাকার পরিবেশ আরও ভীতিকর হয়ে ওঠে। ভোটের আগেই যদি এমন অবস্থা হয়, তাহলে ভোটে জিতলে তারা কি আমাদের খোঁজ রাখবে? সাধারণ মানুষের পাশে থাকবে?'
বাসুদেব সাহার মতে, শেষ পর্যন্ত তারা সেই প্রার্থীকেই ভোট দেবেন যিনি সত্যিকারের জনগণের নেতা হতে পারেন এবং সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্যতা রাখেন।
সদর উপজেলার বেতিলা এলাকার বাসিন্দা তৌয়ব আলী বলেন, আমরা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনপ্রিয় ও যোগ্য ব্যক্তিকেই বেছে নেব। দুর্নীতিগ্রস্ত কিংবা কোনো সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত ব্যক্তিকে সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনীত করব না। এমন মানুষ সংসদে গেলে এলাকার মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ না করে নিজের এবং তার অনুসারীদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেবে। আমরা চাই পরিচ্ছন্ন, সৎ ও যোগ্য একজন মানুষ আমাদের অভিভাবক হিসেবে নির্বাচিত হোক।
জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটির আ. তা. ম. জহিরুল আলম লোদী বলেন, মানিকগঞ্জ–৩ আসনে আফরোজা খানম রিতাকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এই আসলে তিনি একমাত্র যোগ্য। এই আসনে তিনি ছাড়া অন্য কারোর এক পারসেন্টও সম্ভাবনা ছিল না দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার। এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ তার কর্মী বান্ধব আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। দলের দুঃসময়ে প্রতিটি নেতার ওপর হওয়া হামলা মামলা এবং জুলুম তিনি ছায়ার মত প্রত্যেকের পাশে থেকেছেন। সহযোগিতা করেছেন প্রত্যেকটি পরিবারকে। তিনি রাজনীতি করতে এসেছেন মানুষকে দেওয়ার জন্য নেওয়ার জন্য না। এখনো পর্যন্ত যারা তাকে সমর্থন করছে না তাদের ভিন্ন কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। তারা দলের জন্য নিবেদিত কর্মী নন।
মাঠের বাস্তবতা না মেনে পেশি শক্তির মাধ্যমে নিজের অবস্থান জানান দেওয়া রাজনৈতিক অজ্ঞতা ছাড়া কিছুই নয় এমন মন্তব্য করে আহবায়ক কমিটির সদস্য আ.ফ.ম. নূরতাজ আলম বাহার। তিনি বলেন, ছাত্র জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে জুলাই অভ্যুত্থান হয়েছে। রাজধানীর পাশের জেলা হিসেবে মানিকগঞ্জ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ সময় দলের শত শত নেতা কর্মী আহত হয়েছেন; কারা বরণ করেছেন। কারো খোঁজ কি আতা মিয়া নিয়েছেন? নেননি। বিরোধী শিবিরের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে মাঠের পরিস্থিতি ঘোলাটে করছেন তিনি। তিনি নূন্যতম যোগ্য হলেও দল এবং অঙ্গ সংগঠনের কেউ না কেউ তো তার পাশে থাকতো। তার পাশে কেউই নেই আছে শুধু সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণধারী মুষ্টিমেয় কিছু অসাধু এবং অরাজনৈতিক লোকজন।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আপনার অবস্থান কি ? জানতে চাইলে– আতাউর রহমান আতা বলেন, আমার পূর্ণ আস্থা এবং ভরসা দলের ওপর আছে। আমি মাঠে কাজ করে যাচ্ছি আমি আশাবাদী দল আমার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার করবে। আর সেটি না হলে সময়ই বলে দেবে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব।
কুশল/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর