নারায়ণগঞ্জের ঐতিহাসিক সোনারগাঁ-একদিকে বাংলার প্রাচীন রাজধানীর গৌরব, অন্যদিকে আধুনিক সময়ের কঠিন বাস্তবতা। শত শত বছরের ঐতিহ্য বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই জনপদ আজ নানামুখী দুর্ভোগে জর্জরিত। জলাবদ্ধতা, ভূমি জটিলতা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম না পাওয়া, স্বাস্থ্যসেবার সীমাবদ্ধতা-সব মিলিয়ে প্রতিদিনই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে উপজেলার সাধারণ মানুষকে।
এই বাস্তবতার মধ্যেই সোনারগাঁ প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে সম্প্রতি একাধিক নতুন কর্মকর্তা দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। নতুন নেতৃত্ব মানেই নতুন সম্ভাবনা-এ বিশ্বাস থেকেই নতুন করে আশার আলো দেখছেন সোনারগাঁবাসী। তবে একই সঙ্গে তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘদিনের জমে থাকা সমস্যার পাহাড়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসিফ আল জিনাত প্রশাসনের প্রধান সমন্বয়কের ভূমিকায় রয়েছেন। উন্নয়ন কার্যক্রম তদারকি, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং নাগরিক সেবায় শৃঙ্খলা ফেরানোর দায়িত্ব তাঁর কাঁধে।
দীর্ঘদিন ধরে সরকারি সেবা নিতে এসে হয়রানি ও অনিয়মের অভিযোগ করে আসছেন সাধারণ মানুষ। নতুন প্রশাসনিক নেতৃত্বের কাছে তাঁদের প্রত্যাশা-স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে, জবাবদিহিতা বাড়বে এবং দালাল নির্ভরতা কমবে।
সোনারগাঁয়ে সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্ভোগের জায়গা ভূমি সংক্রান্ত সমস্যা। নামজারি, খাজনা, জমি দখল ও পারিবারিক বিরোধ নিয়ে বছরের পর বছর ঘুরছেন অনেকে। সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ তৌফিকুর রহমান ও ফাইরুজ তাসনিম নতুন দায়িত্ব গ্রহণের পর ডিজিটাল ভূমি সেবা কার্যকর করা, অবৈধ দখল উচ্ছেদ এবং দ্রুত বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিচ্ছেন। স্থানীয়দের আশা-নতুন কর্মকর্তাদের দৃঢ়তায় ভূমি অফিসের দীর্ঘদিনের ভোগান্তির অবসান ঘটবে।
চুরি, ছিনতাই, মাদক ও কিশোর অপরাধ নিয়ে উদ্বেগে দিন কাটছে বহু পরিবারের। নিরাপত্তাহীনতার কারণে সামাজিক স্থিতিশীলতাও ব্যাহত হচ্ছে। সোনারগাঁ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মহিবুল্লাহ নতুন দায়িত্বে এসে অপরাধ দমন, মাদকবিরোধী অভিযান এবং পুলিশের সঙ্গে জনগণের আস্থা ফেরাতে মাঠপর্যায়ে সক্রিয় রয়েছেন। নিরাপদ পরিবেশ ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়-এ উপলব্ধিই এখন প্রশাসনের বড় পরীক্ষা।
একসময় পুরোপুরি কৃষিনির্ভর উপজেলা হিসেবে পরিচিত ছিল সোনারগাঁ। বিস্তীর্ণ ফসলি জমি, ধান ও সবজির ক্ষেতই ছিল এই জনপদের প্রধান পরিচয়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চিত্র বদলেছে। গত এক দশকে সড়ক, সেতু ও আবাসনসহ অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি গড়ে উঠেছে অসংখ্য শিল্প কারখানা। শিল্পায়নের এই বিস্তার একদিকে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করলেও অন্যদিকে কমছে কৃষিজমি, চাপে পড়ছেন কৃষকরা।এই পরিবর্তিত বাস্তবতায় কৃষিখাত এখন দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে-একদিকে উৎপাদন ধরে রাখা, অন্যদিকে শিল্পায়নের চাপ মোকাবিলা। কৃষকদের অভিযোগ, জমি কমছে, উৎপাদন খরচ বাড়ছে, অথচ ন্যায্য দাম নিশ্চিত হচ্ছে না। ফলে কৃষি নির্ভর পরিবারগুলোর জীবনযাত্রা আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু সাঈদ তারেক নতুনভাবে দায়িত্ব পালন করে আধুনিক চাষাবাদ, উন্নত বীজ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে কাজ করছেন। তবে কৃষকদের দাবি-বাজার ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী না হলে তাদের দুর্ভোগ কমবে না।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক সংকট, ওষুধের স্বল্পতা ও অতিরিক্ত রোগীর চাপ-দীর্ঘদিনের এই সমস্যাগুলোতেই সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সুমাইয়া ইয়াকুব এবং উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মনিরা মুক্তা দায়িত্ব গ্রহণের পর মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য, টিকাদান কার্যক্রম, পরিবার পরিকল্পনা সেবা ও প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে কাজ করছেন। তবে স্থানীয়দের মতে, জনবল সংকট ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা কঠিনই থেকে যাবে।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোছাম্মৎ নইফা বেগম এবং সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মাহমুদা আকতার নতুন দায়িত্বে এসে খামারি ও জেলেদের প্রশিক্ষণ, রোগ প্রতিরোধ এবং উৎপাদন বাড়াতে উদ্যোগ নিচ্ছেন। এসব উদ্যোগ সফল হলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সামনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সোনারগাঁ প্রশাসনের ভূমিকা আরও বেশি সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে। স্থানীয়দের মতে, নির্বাচন ঘনিয়ে এলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখা এবং সরকারি সেবায় কোনো ধরনের পক্ষপাত না হওয়ার বিষয়টি বড় পরীক্ষায় পরিণত হবে।
সুশীল সমাজের অভিমত, নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জন্য এই নির্বাচন একটি অগ্নিপরীক্ষা। এই সময়ে স্বচ্ছতা, পেশাদারিত্ব ও মানবিক আচরণ নিশ্চিত করতে পারলেই প্রশাসনের প্রতি মানুষের আস্থা দৃঢ় হবে। ব্যর্থ হলে দীর্ঘদিনের দুর্ভোগের সঙ্গে যুক্ত হবে নতুন হতাশা।
সোনারগাঁয়ের স্থানীয় বাসিন্দা কামরুল ইসলাম পাপ্পু বলেন,অনেক কর্মকর্তা নতুন এসেছেন, আমরা নতুন করে আশা করছি। তবে আশা পূরণ হবে কি না, তা নির্ভর করবে তাঁরা কতটা মাঠে থাকেন আর মানুষের কথা শোনেন তার ওপর।
সোনারগাঁয়ের একজন বিশিষ্ট সুশীল নাগরিক ও শিক্ষাবিদ বলেন,সোনারগাঁর সমস্যাগুলো নতুন নয়-এগুলো বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা। নতুন কর্মকর্তাদের সামনে সুযোগও আছে, চ্যালেঞ্জও আছে। উন্নয়ন তখনই দৃশ্যমান হবে, যখন প্রশাসন মানুষের পাশে দাঁড়াবে।
আরেকজন স্থানীয় নাগরিক খাইরুল ইসলাম বলেন,দুর্ভোগ আর প্রত্যাশার এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে সোনারগাঁ। নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের হাতেই এখন মানুষের ভাঙা আস্থা পুনর্গঠনের সুযোগ। প্রশাসনের প্রতিটি দপ্তরের সমন্বিত, মানবিক ও জবাবদিহিমূলক ভূমিকা নিশ্চিত হলেই বদলাতে পারে এই ঐতিহ্যবাহী জনপদের ভবিষ্যৎ।
সাজু/নিএ
সর্বশেষ খবর