জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে উপকূলীয় জনপদে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে গর্ভবতী নারী, শিশু ও কিশোরীরা। লবণাক্ততা, নিরাপদ পানির সংকট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটায় স্বাস্থ্যসেবা হয়ে উঠছে চ্যালেঞ্জের। এই বাস্তবতায় মাঠপর্যায়ের কার্যকর সমাধান তুলে ধরতে সাতক্ষীরার আশাশুনিতে অনুষ্ঠিত হলো রিচ প্রকল্পের কার্যক্রম বিষয়ক ডিসেমিনেশন ও লার্নিং-শেয়ারিং সভা।
বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় আশাশুনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আয়োজিত এ সভায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবেলায় বাস্তবায়িত উদ্যোগ, মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা, অর্জিত শিক্ষণফল এবং ২০২৬ সালের পরিকল্পিত কার্যক্রম উপস্থাপন করা হয়। সুইস দূতাবাস ও সুইস উন্নয়ন সংস্থা এনফাঁন্টস ডু মন্ডে (ইডিএম)-এর আর্থিক সহায়তায় এবং ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)-এর বাস্তবায়নে “জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে গর্ভবতী নারী, শিশু ও কিশোরীদের সুরক্ষা বিষয়ক (রিচ)” প্রকল্পটি আশাশুনি উপজেলার আশাশুনি সদর, আনুলিয়া ও প্রতাপনগর ইউনিয়নে পরিচালিত হচ্ছে।
সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা. মো. আব্দুস সালাম। তিনি বলেন, “উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে মা ও শিশু স্বাস্থ্যের ওপর। নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্যসেবা ও জরুরি চিকিৎসার ঘাটতি এই ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। রিচ প্রকল্প মাঠপর্যায়ে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে এই সংকট মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।”
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সাতক্ষীরার ডেপুটি ডিরেক্টর রওশন আরা জামান বলেন, “স্বাস্থ্যকর্মীদের দক্ষতা উন্নয়ন, স্বাস্থ্যকেন্দ্র সংস্কার এবং নিরাপদ পানির ব্যবস্থা নিশ্চিতের মাধ্যমে রিচ প্রকল্প উপকূলীয় অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে একটি কার্যকর মডেল হিসেবে কাজ করছে।”
সভায় সভাপতিত্ব করেন আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাইদুজ্জামান হিমু। সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেন, “স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য বিভাগের সমন্বয়ে পরিচালিত এই প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদে আশাশুনির স্বাস্থ্যখাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। জলবায়ু সহনশীল স্বাস্থ্যসেবার জন্য এমন উদ্যোগ সময়োপযোগী ও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।”
ডিসেমিনেশন ও লার্নিং-শেয়ারিং বিষয়ক প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন রিচ প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. মাসুকুল হক মাসুক। তিনি প্রকল্পের অর্জন, চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরেন।
উদ্বোধনী বক্তব্যে ইডিএম বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর শামীমা আক্তার শিমুল বলেন,“জলবায়ু পরিবর্তন শুধু পরিবেশগত সংকট নয়, এটি একটি বড় মানবিক ও স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জ। উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর মা, শিশু ও কিশোরীরা এই সংকটের সবচেয়ে নীরব ভুক্তভোগী। রিচ প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা স্থানীয় চাহিদার ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবাকে আরও সহনশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই করতে কাজ করছি।”
তিনি আরও বলেন, “এই প্রকল্পের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো কমিউনিটির অংশগ্রহণ। স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মী, জনপ্রতিনিধি ও উপকারভোগীদের সম্পৃক্ততার মাধ্যমেই জলবায়ু সহনশীল স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। ভবিষ্যতেও আমরা সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে এই উদ্যোগ সম্প্রসারণে আগ্রহী।”
অনুষ্ঠানে সিনিয়র সাংবাদিক শরীফুল্লাহ কায়সার সুমন তার বক্তৃতায় বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে আমরা অনেক সময় কেবল দুর্যোগের খবরই তুলে ধরি। কিন্তু রিচ প্রকল্প দেখাচ্ছে—চাইলেই মাঠপর্যায়ে সমাধানমুখী ও মানবিক উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব। মা ও শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এই ধরনের প্রকল্প শুধু সেবা নয়, ভবিষ্যতের জন্য একটি দিকনির্দেশনাও তৈরি করছে। গণমাধ্যমের দায়িত্ব হলো এসব ইতিবাচক উদ্যোগকে তুলে ধরে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।”
ইএসডিও’র পক্ষে বক্তব্য রাখেন সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার শামসুল হক মৃধা। তিনি বলেন, প্রকল্পের কার্যক্রম মাঠপর্যায়ে বাস্তব পরিবর্তন আনছে এবং উপকারভোগীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াচ্ছে।
সভায় জানানো হয়, রিচ প্রকল্পের মূল কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে—ফ্রন্টলাইন স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ, কমিউনিটি পর্যায়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার সেন্টার সংস্কার, নিরাপদ পানির উৎস উন্নয়ন, জরুরি স্বাস্থ্যসেবায় ইকো-ফ্রেন্ডলি মোবাইল অ্যাম্বুলেন্স প্রদান এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা লজিস্টিকস সহায়তা নিশ্চিত করা।
অনুষ্ঠানে উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, এনজিও প্রতিনিধি, স্বাস্থ্যকর্মী, প্রকল্প টিমের সদস্য এবং উপকারভোগী মা ও কিশোরীরা উপস্থিত ছিলেন। একজন উপকারভোগী মা বলেন, “আগে অসুস্থ হলে অনেক কষ্টে চিকিৎসা পেতাম। এখন এই প্রকল্পের মাধ্যমে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সহায়তা সহজেই পাচ্ছি।” উল্লেখ্য, অংশগ্রহণমূলক কমিউনিটি মূল্যায়নের মাধ্যমে স্থানীয় চাহিদা অনুযায়ী কার্যক্রম পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করে রিচ প্রকল্প উপকূলীয় মা, শিশু ও কিশোরীদের জন্য জলবায়ু সহনশীল স্বাস্থ্যসেবার একটি কার্যকর ও টেকসই মডেল হিসেবে কাজ করছে।
আলোচনা সভা শেষে অংশগ্রহণকারী ও উপকারভোগী মা তিথি বিশ্বাস মত প্রকাশ করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা টেকসই করতে হলে সরকার, উন্নয়ন সংস্থা, স্থানীয় প্রশাসন ও কমিউনিটির সমন্বিত উদ্যোগ অপরিহার্য। রিচ প্রকল্পের অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে অন্যান্য উপকূলীয় উপজেলাতেও জলবায়ু সহনশীল স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণে কার্যকর পথনির্দেশনা হিসেবে কাজ করবে বলে সভায় আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়।
তাসনিম আকতার নেহা বলেন, আগে ঝুঁকির সময় কী করবো বুঝতাম না। এই উদ্যোগের মাধ্যমে সচেতনতা ও সহায়তা পেয়ে এখন নিজের স্বাস্থ্য ও পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী।
সাজু/নিএ
সর্বশেষ খবর