ঘড়িতে সকাল আটটা। হেডলাইট জ্বালিয়ে গাইটাল থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে একটি বাস রওনা দিল। কন্ডাক্টর চালককে হাঁক দিয়ে বললেন, 'ওস্তাদ আস্তে চালায়েন, কুয়াশায় সামনে কিছু দেহা যাইতাছে না'।
এ সময়ে বাসস্ট্যান্ডে মানুষের মোটামুটি ভিড় থাকে। এখন লোকজন নেই। যেন সকালই হয়নি। কুয়াশা আর হিমেল বাতাসের দাপটে যাত্রীরা বাসার বাইরে বের হতে পারেনি।
কনকনে ঠান্ডায় কাবু কিশোরগঞ্জ শহরের কর্মচঞ্চলতা নেই। রাস্তাঘাটে মানুষ নেই। তবে শ্রমজীবী মানুষের কিছু আনাগোনা ছিল।
আবহাওয়া অফিস বলছে, রোববার সকাল ৯টায় কিশোরগঞ্জের নিকলীতে দেশের সর্বনিম্ন ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এ সময় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ১০০ শতাংশ।
সকাল সাড়ে আটটা। শহরের একরামপুর টেম্পু স্ট্যান্ডে সিএনজি-অটোরিক্সার ভেতর চাদর মুড়িয়ে গুটিসুটি মেরে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন এক চালক। কুয়াশার কারণে কোনো যাত্রী আসেনি।
একরামপুর থেকে ১৮ কিলোমিটারের পথ করিমগঞ্জ উপজেলার গুনধর ইউনিয়নের খয়রত গ্রাম। হাওরের অন্যতম প্রবেশদ্বার এটি। খয়রত মোড়ে সকাল থেকে রাত ১২টার পরও পর্যটকসহ নানান ধরণের মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। কিন্তু রোববার সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে দেখা যায়, ঠান্ডা বাতাসের কারণে কোনো লোকসমাগম নেই। শিশুকে কোলে নিয়ে ছাপড়া দোকানের পাশে বসে ছিল শুধু এক নারী। আশপাশে আর কেউ নেই।
খয়রত গ্রামের পাশে মরিচখালি বাজার। করিমগঞ্জ উপজেলার আরেকটি ব্যস্ত জায়গা। বাজারে সকাল থেকেই অটোরিকশার ভিড় শুরু হওয়ার কথা। ঘড়িতে সময় সকাল পৌনে দশটা। কিন্তু তখন পর্যন্ত কোনো যাত্রীবাহী রিকশা নেই। দীর্ঘক্ষণ পর দোকানের মালপত্র নিয়ে একটি ভ্যানগাড়ি যেতে দেখা যায়। সোনালী ব্যাংকের নিচে এক যুবক পুরোনো গরম কাপড়ের দোকান মেলার চেষ্টা করছেন। এর সামনের গালিটা একেবারে ফাঁকা। দোকানপাট বন্ধ। রাস্তাও ফাঁকা।
বাজারে সাড়ে দশটার দিকে দেখা হয় দক্ষিণ আশতকা গ্রামের কৃষক মোমতাজ আলীর সঙ্গে। এক হাতে তার পানির জগ। আরেক হাতে লুঙ্গি দিয়ে মুড়ানো গরম ভাতের টাগারি। থালা বাসনও আছে । হাওরে যাচ্ছেন।
মোমতাজ আলী বললেন, 'বন্দের (হাওরের) পানি নেমে গেছে। দুই দিন ধরে খেত শুকিয়ে আছে। ঠান্ডার কারণে হাল দিতে পারতাছি না। শীতের লাগি কামলা বেডাইন খেতঅ যায় না। এহন কি করাম, শীত ভাইঙ্গা নিজেই যাইতাছি বন্দে। দুই ছেড়া বন্দে কাজ করতাছে। হেরার লাগি ভাত লয়া যাইতাছি।'
একটু এগোতেই নজরুলের ভাতের হোটেল। কম মূল্যে খাবার পাওয়া যায় বলে সকাল থেকেই সেখানে শ্রমজীবী মানুষের ভিড় থাকে। সকাল প্রায় দশটা বেজে গেলেও দোকানের চুলায় আগুন দেয়া হয়নি। কোনো কারিগরও নেই চুলার পাশে। শুধু দোকান খুলে রাখা হয়েছে।
বাজার পেরিয়ে ইন্দাচুল্লি যাওয়ার রাস্তাটা একেবারে অচেনা। একটি মাত্র রিকশা যাচ্ছে। দুই কিলোমিটার দূরে কয়েকটি গ্রাম। সড়ক থেকে কুয়াশায় মোড়ানো গ্রামগুলো দেখা যাচ্ছে না।
বাজারে চায়ের দোকানের ঝাঁপ খুললেন বরজু মিয়া। ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দিতে দিতে কথা হয় তার সঙ্গে, ‘বিহিকিনি একদম নাই ভাইসাব। সকাল আটটার সময় দোকান খোলি। শীতের কারণে আইজ দশটার সময় দোকান খুলছি। এরপরেও লোকজন নাই। কেমনে আইবো কইন লোকজন। এহনোও তো উষ (কুয়াশা) কমতাছে না। আপনিই আমার প্রথম কাস্টমার। দুইদিন ধইরাই ঠান্ডা পড়ছে। এইভাবে দিন থাকলে সংসার চালানো কষ্ট অয়া যাইবো।' -বলছিলেন তিনি।
ঘড়িতে সময় ১০টা ৪৫। চালের দোকান খুললেন রাসেল মিয়া। এরই মধ্যে কাঁচাবাজারের সামনে শুক্কুর নামের একজন সবজি বিক্রেতা কয়েকটি সবজি নিয়ে বসেছেন। তখনও সূর্যের দেখা মেলেনি। মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বইছিল। পাশে কলা গাছের দীর্ঘ পাতাগুলো না না করে কাঁপছিল।
নিকলী প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম মাসুম আমাদের কিশোরগঞ্জ জেলা প্রতিনিধিকে জানান, 'রোববার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল কিশোরগঞ্জে। আর এ মৌসুমে এটাই দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা।
তিনি জানান, '২০১৪ সাল থেকে নিকলীতে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের কাজ শুরু হয়েছে। গত বছরও শীতে দুই দিন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় নিকলীতে। আজ (রোববার) এ বছরের প্রথম সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় এখানে।'
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর