‘বাবা বলতেন, তোমার মত বাউলের এই বাড়িতে জায়গা নেই’
‘এই রুপালী গিটার ফেলে, এক দিন চলে যাবো দূরে বহু দূরে... গানে গানে কথা গুলো বলে গিয়েছিলেন বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের কিংবদন্তী শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু। গানের কথার মতই রুপালী গিটার ফেলে তারা ভরা রাতের শেষে এক সকালে সবাইকে কাঁদিয়ে উড়াল দিল আকাশে। গত বৃহস্পতিবার (১৮ অক্টোবর) সকালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন আইয়ুব বাচ্চু।
উপমহাদেশের এই গিটারের জাদুকর জন্মগ্রহন করেছিলেন চট্টগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে। শুরুর দিকে এলাকায় বন্ধু বান্ধবের সাথে গান করতেন। প্রথম দিকে এই গান নেশা থাকেও পরবর্তিতে তা পরিণত হয় পেশায়। শুধুমাত্র এই গানের জন্য হয়ছেন সংসার থেকে অনেকটা দূরে রয়েছেন তিনি। মৃত্যুর আগে আইয়ুব বাচ্চু বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকারে তার গান শুরুর দিকের স্মৃতি নিয়ে বলেছিলেন, ‘বাবা কখনোই চাননি আমি এই লাইনে থাকি। বাবা বলতেন তুমি শেষ, তোমার মত বাউলের এই বাড়িতে কোন জায়গা হবে না।’
বেশ কষ্ট ও অভিমান নিয়ে আইয়ুব বাচ্চু বলেছিলেন, ‘আসলেই এই বাউলগিরি করে আমার জীবন শেষ’। কোথায় যেন তার দুঃখ ছিল, ছিল অভিমান। তাই হয়তো গেয়েছিলেন, এই বুকের যন্ত্রনা বেশী সইতে পাড়ি না, এতবেশী কাঁদালে উড়াল দিব আকাশে।
গিটারের সেবক আইয়ুব বাচ্চু গান গেয়ে প্রথম আয় করেন ৩০ টাকা। যা কিনা বর্তমানে ৩০০০০ এর সমান। চট্টগ্রামে এক প্রোগ্রামে গান গেয়ে তার এই আয়। তবে পারিবারিক সাপোর্ট না থাকার জন্য সে সময় নিজের গানের জন্য যে খরচ হত তা তাকে নিজেরই বহন করতে হতো। সে স্মৃতি মনে করে আইয়ুব বাচ্চু বলে ছিলেন, ‘প্রথম আয় সবার জন্যই খুব আনন্দের। আমারও ছিল। ইচ্ছে ছিল সেই টাকাগুলো যদি রেখে দিতে পাড়তাম। চাইলেও পারিনি, কেননা তখন নিজের খরচ নিজেকেই চালাতে হতো।’
গান গেয়ে যেই মানুষটি সারা জীবন পার করলেন সেই মানুষটি তার নিজের ছেলেকেই তার পেশায় আসতে দেননি। অনেকেই এটা নিয়ে বেশ কয়েকবার আইয়ুব বাচ্চুকে প্রশ্ন করেছিলেন আর প্রতিবার তিনি জবাবে বলেছিলেন, ‘আমি এই পেশায় যত কষ্ট করে ঘাম ঝড়িয়ে টাকা উপার্জন করেছি, আমি চাই না আমার ছেলে এত কষ্ট করুক। কেননা আমি বাবা হয়ে তা মেনে নিতে পারব না। তাই তাকে পড়াশোনার জন্য বাইরে পাঠিয়েছি। বলে দিয়েছি গান করবে শখে। যখন তুমি চাকরি করে বিশাল বাংলোয় থাকবে, তোমার বাসায় রুম ভরা গিটার থাকবে, তোমার বন্ধুরা আসবে তোমার গিটার বাজানো শোনার জন্য।’
এতো লম্বা ক্যারিয়ারে তার কোন বদনাম নেই বললেই চলে। ছোটদের যেমন দিয়েছিলেন ভালোবাসা। ঠিক তেমনি বড়দের দিতেন শ্রদ্ধা। বেশিভাগ সময়ে তিনি মজা করে বলতেন দুর্ণাম করলেই দুর্ণাম হবে তাই কিছু না করাটাই ভালো।
নিজেকে কখনোই গিটার বাদক মনে করেননি তিনি। সব সময় বলতেন আমি গিটার বাদক নই আমি গিটারের সেবক। দীর্ঘ দিনের ক্যারিয়ারে গিটারের সেবক পেয়েছেন কোটি ভক্তের ভালোবাসা। তারপরও কোথায় যেন ছিল তার এক অপূর্ণতা। বেশ হতাশা নিয়ে তাকে একবার বলতে শোনা গিয়েছিল, সব কিছু থেকে পালিয়ে যেতে চাই অনেক দূরে। অনেক তো করলাম আর করতে ভালো লাগছে না কিন্তু কেন এই পালিয়ে যাওয়ার ভাবনা জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘হলো তো, সবই করেছি, সবাই বড় হয়েছে, চারপাশের সবাই বড় হয়েছে, এখন সবাই সেটেল। তাই এখন বর্ব মার্লির মতো হয়ে যেতে চাই।’
পরিবারের সবাইকে এক সাথে নিয়ে থাকতে চেয়েছিলাম উল্লেখ করে আইয়ুব বাচ্চু বলে ছিলেন, ‘আমার দাদা-দাদী, চাচা-চাচী সবাই এক সাথেই থাকতো। এক উঠনেই আমারা সবাই থাকতাম। আমিও তাই চেয়েছিলাম কিন্তু আমার মনে হয় এইটা অযৌতিক। এখনও আমি সেকালে রয়ে গেছি। এখন পাশের বাড়িতে মানুষ থাকবে কিন্তু কেউ তার খবর জানবে না।’
প্রতিটা সময়ই তিনি শিল্পীদের সম্মানের কথা বলেছেন। তিনি মনে করতেন যখন সবাই শিল্পীদের মনে করবে তাদের পেট আছে, পরিবার আছে, সামাজিকতা আছে তখনই এক জন শিল্পীকে সম্মান করা হবে। অনেকের হয়তো অজানা গিটারের এই সেবক একজন সমাজ সেবীও ছিলেন। তিনি অনেক অসহায়দের পাশে বিভিন্ন ভাবে দাঁড়াতেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন আর বলতেন আমি ডান হাতে কি করেছি সেটা যেন আমার অন্য হাত না জানে।
যেই মানুষটি সব সময় মা, দেশকে নিয়ে কথা বলছেন, বলেছেন বদলে যাওয়ার কথা সেই মানুষটি হুট করেই সবাকে ছেড়ে চলে গেলেন। নিজের শারীরিক অসুস্থতার কথা তিনি নিজে জানলেও কখনো তার গানে, কথায় বুঝতে দেননি কাউকে। তার এই চলে যাওয়া আজ সবাইকে ভাবায় তিনি কি অভিলাসি না অভিমানী?
কিংবদন্তীদের কখনও মৃত্যু নেই। তিনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন। আর তার সেই রুপালি গিটার দিয়ে মহল্লার চায়ের দোকানে, কলেজের ক্যান্টিনে কিংবা খোলা মাঠে তরুণ প্রজম্নের কণ্ঠে ছয় তারের সুরে শোনা যাবে ‘চলো বদলে যাই’।
বিডি২৪লাইভ/এএ/এমআর
বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এডিটর ইন চিফ: আমিরুল ইসলাম আসাদ
বাড়ি#৩৫/১০, রোড#১১, শেখেরটেক, ঢাকা ১২০৭
ই-মেইলঃ [email protected]
ফোনঃ (০২) ৫৮১৫৭৭৪৪
নিউজ রুমঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯১
মফস্বল ডেস্কঃ ০১৫৫২৫৯২৫০২
বার্তা প্রধানঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯০
মার্কেটিং ও সেলসঃ ০৯৬১১১২০৬১২
ইমেইলঃ [email protected]
পাঠকের মন্তব্য: