কেন খারাপ চিন্তা মাথায় আসে ?

প্রকাশিত: ২০ আগষ্ট ২০১৪, ১০:৫৬ পিএম

চিন্তা যেমন হবে অনুভূতি তেমনই হবে, অনুভূতি যেমন হবে কাজ তেমন হবে। একই কাজ বারে বারে করলে সেটি অভ্যাসে পরিণত হয়। আর অভ্যাস চরিত্রে রুপান্তরিত হয়। আর চরিত্র মানুষকে নিয়ে যায় তার গন্তব্যে। সুতরাং, মূল হলো চিন্তা। অর্থাৎ আমরা ভালো চিন্তা করলে ভালো বোধ করি মনে আনন্দ অনুভূতি সৃষ্টি হয় ফলে সবার সাথে তখন ভালো আচরণ করি। আমাদের প্রতিটি কাজ তখন ইতিবাচক ও গঠনমূলক হয়। ভালো কাজ বারে বারে করতে থাকলে সেটি অভ্যাসে পরিণত হয়। ভালো অভ্যাস ভালো চরিত্র সৃষ্টি করে। আর ভালো চরিত্রের মানুষ ভালো স্থানে অর্থাৎ সুখ ও শান্তির গন্তেব্যেই পৌঁছাবেন। সুতরাং সুখ ও শান্তিত্ম এবং জনপ্রিয়তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে মূল উৎপত্তি স্থল চিন্তাকে ইতিবাচক করতেই হবে।

আমরা চিন্তাকে সৃষ্টি করি। সেই চিন্তা ইতিবাচক হবে না কি নেতিবাচক হবে সেটি কিসের উপর নির্ভর করে? সেটি নির্ভর করে মূলত: তিনটি বিষয়ের উপর।

১) তথ্যের ধরনের উপর

২) অতীত অভিজ্ঞতার উপর

৩) বিশ্বাসের ভিত্তির উপর।

এই তিনটি বিষয় যদি আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারি তবে আমাদের চিন্তা কেন নেতিবাচক বা ইতিবাচক হচ্ছে তা বোঝা যাবে।
১। তথ্যের ধরণ : কোয়ালিটি অফ ইনফরমেশন, অর্থাৎ কি ধরন তথ্যের মধ্যে আপনি থাকছেন বা কোন পরিবেশে আপনি থাকছেন সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেমন আপনি হয়তো কাস্টমস বা পুলিশে চাকরি করছেন, আপনি অফিসে গিয়ে যদি সব সময় নেতিবাচক তথ্য পেতে থাকেন, যেমন আপনার সমপর্যায়ের কর্মকর্তা দুইটি বাস কিনেছেন, দুইটি ফ্লাট কিনেছেন, অমুক কর্মকর্তা গ্রামে বিশাল জমি জমা করেছেন, এভাবে অসৎ নেতিবাচক তথ্য আপনি পেতে থাকলে আপনারও ব্রেইনে সৃষ্টি হতে পারে- তারা যদি এভাবে সম্পদ তৈরি করতে পারে, তবে আমি নয় কেন? অর্থাৎ নেতিবাচক পরিবেশে বা নেতিবাচক তথ্য গ্রহণ করতে করতে মানুষের ব্রেইনে অসৎ চিন্তার সৃষ্টি হয়। মানুষ ক্রমান্বয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

ঠিক বিপরীত পরিস্থিতি ভাবুন। যেমন আপনি উন্নত কোন এক দেশে কোন এক সংস্থায় কাজ করছেন। আপনি সারাদিন এবং সব সময় ভালো, সুন্দর, ইতিবাচক কথা শুনছেন। মানুষ সততার সাথে, পরিশ্রমের সাথে সম্পদশালী হচ্ছে। দুর্নীতি কেউ ভাবেও না করেও না। অর্থাৎ ইতিবাচক তথ্যে আপনি সমৃদ্ধ হচ্ছেন ফলে আপনার ইতিবাচক চিন্তাই সৃষ্টি হবে আপনি দুর্নীতি করে সম্পদশালী হবেন, নাকি সততার সাথে সম্পদশালী হবেন, ভাল কাজ করবেন না খারাপ কাজ করবেন তা নির্ভর করছে আপনি কি ধরনের তথ্যের মধ্যে অবস্থান করছেন এবং প্রভাবিত হচ্ছেন তার উপর।

২। অতীত অভিজ্ঞতা : অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের চিন্তা সৃষ্টিতে প্রভাব পড়ে। যেমন আপনি কাউকে টাকা ধার দিয়েছিলেন (তাকে বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্য)। কিন্তু তার কাছ থেকে টাকা ঠিক মত ফেরত পান নাই। এরকম যতজনকেই টাকা ধার দিয়েছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টাকা ফেরত পেতে আপনাকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে টাকা ফেরত পান নাই। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে আপনি যদি সিদ্ধান্ত নেন যে টাকা দিলে ঠিকমত ফেরত পাওয়া যায় না। সুতরাং টাকা ধার দেয়া উচিত নয়। ফলে আপনি নিজেও কাউকে ধার দেন না অন্যকেও অনুৎসাহিত করেন। এটি একটি নেতিবাচক সিদ্ধান্ত এবং এই নেতিবাচক সিদ্ধান্তটি এলো নেতিবাচক চিন্তা থেকে এবং সেটিকে প্রভাবিত করেছে নেতিবাচক অতীত ঘটনা। বিষয়টি হলো যিনি টাকা ফেরত দেননি অথবা দিতে ঝামেলা করেছেন সেটি তার মানসিক সমস্যা, তার অসততা। তাই বলে টাকা ধার দেবার মত একটি পরোপকারী কাজ থেকে আপনি বিরত থাকতে পারেন না। মানুষ মানুষকে সহযোগিতা করবে, সাহায্য করবে, বিপদ থেকে উদ্ধার করবে, এটাই স্বাভাবিক। সত্য সত্যই। সুন্দর সুন্দরই। ভালো কাজ ভালো কাজই। সেটা করতে গিয়ে আপনি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তার জন্য আপনি দায়ী নন। যেমন আপনি মানুষের উপকার করতে গিয়ে অনেক সময় বিব্রত হয়েছেন, কখনো হয়তো অপমানিত হয়েছেন। অতীতের এই অভিজ্ঞতা থেকে আপনি যদি মানুষের সহযোগিতা বা উপকার করা ছেড়ে দেন তবে এটি ভুল সিদ্ধান্ত। ভালো কাজটাই আপনাকে করে যেতে হবে। চূড়ান্ত বিজয় এবং সুখময় জীবন আপনারই হবে। অসৎ মানুষ কখনই সুখ-শান্তির নাগাল পায় না।

৩। বিশ্বাসের ভিত্তি : এই বিষয়টি চিন্তা সৃষ্টির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মানুষ যে বিশ্বাসে গড়ে ওঠে, বেড়ে ওঠে ওটাকেই সে চিন্তার ভিত্তি তৈরি করে নেয় এবং আচরণের মধ্যে তার প্রকাশ ঘটে। যেমন ছোট বেলায় আপনার বাবা/মা আপনাকে বকা দিলে বা ভয় দেখালে আপনি পড়তে বসতেন। বাবার মুড খারাপ থাকলে চুপ চাপ পড়ার টেবিলে পড়তে বসতেন। অর্থাৎ আপনি এই বিশ্বাসে বড় হয়েছেন যে বকলে পড়তে হয়, মারলে পড়তে হয়। ফলে দেখা গেছে আপনি যখন বাবা হয়েছেন তখন আপনিও বাচ্চাকে বকা দিয়ে বা নেতিবাচক আচরণ সৃষ্টি করে পড়ায় মনোযোগী করার চেষ্টা করছেন। আপনার বিশ্বাসের ভিত্তি হচ্ছে বকা দিলে, মার দিলে বাচ্চা পড়বে। এটি সম্পূর্ণ ভুল বিলিভ সিস্টেম। আদর করে বুঝিয়ে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করে এর চাইতে বহুগুণ বেশি পড়ায় মনোযোগী করানো যায়। রেজাল্টও অনুরূপ হয়।

আর একটি উদাহরণ- আপনি এবং আপনার সহকর্মী বা বন্ধুর সাথে কোথাও বেড়াতে গিয়েছেন, কোন লোকালয়ে বা অনুষ্ঠানে। দেখা গেলো লোকজন আপনার সঙ্গীর সাথে কুশল বিনিময় করছে বা তার সাথে হ্যান্ডশেক করছে, তাকে সালাম দিচ্ছে। অর্থাৎ আপনি তার পাশে আছেন ঠিকই কিন্তু আপনাকে কেউ উষ্ণতা জানাচ্ছে না, সবাই তাকেই চেনে এবং তাকেই শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। এই বিষয়টি আপনার কেমন লাগবে? অধিকাংশের অভিমত তাদের খারাপ লাগবে, বিরক্ত লাগবে, নিজেকে ইনফিরিওর মনে হবে ইত্যাদি। যার ফলে আপনার নেতিবাচক চিন্তা তৈরি এবং অসুন্দর আচরণ প্রকাশিত হবে। এর কারণ কি? কারণ হচ্ছে আপনার বিলিভ সিস্টেম। আপনার ভুল বিশ্বাসের ভিত্তি। আপনার খারাপ লাগার কারণ হচ্ছে আপনি এই বিশ্বাসে তৈরি হয়েছেন যে অন্যকে প্রশংসা করলে, অন্যকে অভিনন্দন জানালে, সেই আপনার চাইতে সুপিরিয়র, সম্মানিত, গুরুত্বপূর্ণ ইত্যাদি। এই বিলিভ সিস্টেম ভুল। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে, যেমন এক ব্যক্তি সংসদ সদস্য হলেন বা মন্ত্রী হলেন। দেখা গেলো তার বাড়িতে বিভিন্ন মানুষ প্রতিদিন ভিড় করছে, ফুলের তোড়া, উপহার সামগ্রী প্রদান করছে, পায়ে সালাম করছে, প্রশংসা করছে প্রভৃতি। অথচ তিনিই পরের নির্বাচনে যখন সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী কিছুই হতে পারলেন না। দেখা গেলো মানুষ তো দূরের কথা কাক-পক্ষিও যেন তার বাসায় আসে না। এর অর্থ কি? তার সেই সম্মান, মর্যাদা কোথায় গেল! পূর্বের কাজগুলো কি তাকে সম্মান বা মর্যাদা দেয়ার জন্য করা হয়েছিল? নিশ্চয় নয়! তার কাছ থেকে সুযোগ আদায়ের জন্যই করেছিল। সুতরাং ফুলের তোড়া বিভিন্ন উপহার দেয়া মানে এই নয় যে সে আপনার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ বা দায়িত্ববান বা মর্যাদাবান ব্যক্তি। হতে পারে কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে সে আপনার চাইতে দক্ষ বা নির্দিষ্ট গুণে সে জনপ্রিয়, কিন্তু আপনি অন্য কোন বিষয়ে গুণে অনেক দক্ষ বা মর্যাদাবান। সুতরাং আপনার মন খারাপ হবার কারণ হলো আপনার ভুল বিলিভ সিস্টেম। আপনি যখন মনে করবেন তার জায়গায় সে, আমার জায়গায় আমি। নির্দিষ্ট বিষয়ে সে পারদর্শী ও প্রশংসা পেতেই পারে। পাওয়াই উচিত। আমারও উচিত তাকে অন্যদের মত এপ্রিশিয়েট করা। এই বিলিভ সিস্টেম থাকলে দেখবেন লোকজন আপনার পরিচিত কারো প্রশংসা আপনার সামনে করলে আপনার খারাপ না লেগে বরং ভালো লাগবে। আপনার আত্মীয় স্বজনের উন্নতিতে আপনার ভালো লাগবে। অন্যের এগিয়ে যাওয়াকে আপনি আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানাতে পারবেন। মনে হবে এটি তার প্রাপ্য, এটি তার অধিকার। তখন আপনারও ইচ্ছা হবে তাকে অভিন্দনের মাধ্যমে তার প্রাপ্তিকে স্বীকৃতি দিতে। হিংসা লাগবে না বরং খুশি লাগবে।

উপসংহার ঃ মানুষ দুর্নীতি করে, অপরাধ করে, মানুষকে ঠকায় যা কিছু নেতিবাচক কাজ করে, তা তার নেতিবাচক চিন্তা থেকে উৎসারিত। মানুষের আচরণ এবং কাজ তার চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। অন্যের জিনিস আত্মসাৎ করে, মনে করে আমি চালাক, সবাই বোকা। বাহাদুরের মত কাজ করছি। সুযোগের সদ্ব্যবহার করছি। ঐ সবই ভুল বিশ্বাসের ভিত্তি। এসব কাজ বা কর্মকা- সারা জীবন তাকে মানসিক হীনমন্যতায় ভোগাবে। বিবেকের কাছে তার সব সময় মনে হবে আমি অপরাধী। মানসিক চাপজনিত বিভিন্ন রোগে ক্রমান্বয়ে আক্রান্ত হতে শুরু হবে, যে রোগগুলো সাইকোসোমাটিক অর্থাৎ মনোদৈহিক রোগ বলে যেমন, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, পেটের পীড়া ক্যানসার প্রভৃতি।

আনন্দময়, সুস্থ জীবন চাইলে চিন্তাকে ইতিবাচক করতে হবে কারণ “ইউ আর দা ক্রিয়েটর অফ ইউর ওন থট”, আপনি আপনার চিন্তাকে সৃষ্টি করেন। আপনি ভালো চিন্তা যেমন সৃষ্টি করতে পারেন। অন্যদিকে খারাপ চিন্তা বা ধ্বংসকারক চিন্তাও সৃষ্টি করতে পারেন। মনে রাখতে হবে যে, আমাদের ব্রেন হলো সফটওয়ার/রেকর্ডার। যা রেকর্ড হবে সেটাই বাজবে। ব্রেনে যাতে ভালো কিছু রেকর্ড হয় তার ব্যবস্থা করা। এ কারণেই ভালো পরিবেশে থাকা, ভালো বই পড়া, মহান ও মহৎ ব্যক্তিদের জীবনী পাঠ করা, সফল ও বিজয়ী ব্যক্তিদের গল্প প্রবন্ধ পড়া। পরোপকারী বিজয়ী বীরদের চলচ্চিত্র দেখা যাতে ইতিবাচক তথ্য ব্রেনে রেকর্ড হয়। ভালো মানুষ, ইতিবাচক চিন্তার মানুষদের সাথে বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক রাখা। মূর্খ ও নেতিবাচক চিন্তার ব্যক্তিদের এড়িয়ে চলা। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও অনুগত থাকা। তবেই একজন সুন্দর ইতিবাচক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠা সম্ভব।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: