উপন্যাসকেও হার মানানো কথিত জিনের বাদশার কাহিনী

গাজী জয়নাল আবেদীন,
চট্টগ্রাম প্রতিনিধি:
রাত দুপুরে মোবাইলে রিং। ঘুম ভাঙ্গা আতংকিত নারী পুরুষ মোবাইল কানে দিলে শুনতে পায় ব্যতিক্রম কন্ঠের প্রতিধ্বনি। অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে আছ্ছালামু আইকুম অথবা নমষ্কার। তারপর পরিচয় আমি জ্বীনের বাদশা। কম্পিউটারে রেকর্ড করা কম্পমান কন্ঠটি প্রতিধ্বনিত হয় কয়েক সেকেণ্ড ধরে।
তারপর ব্যতিক্রমী হেসে হেসে কিছুক্ষণ নিরবতা। আবার ভেসে আসা কন্ঠস্বর “আমি তোর উপকার করতে চাই” অথবা “তোকে ধনবান করে দিতে চাই”। আবার কম্পমান কন্ঠে সালাম দিয়ে ফোন কেটে দিয়ে বিদায় নেয় পরে আবারো যেকোনো সময় কথা বলবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে। এভাবে রাতে টার্গেট করে ফোন করা হয় বহু নারী পুরুষকে। কাউকে ধনপতি বানিয়ে দেয়ার কথা বলে আবার কারো মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষার কথায় আশ্বস্থ করে। জ্বীনের বাদশার ফোনে অনেকেই মুগ্ধ হয়ে প্রতিক্ষার প্রহর গুনে আবার কখন সেই জ্বীনের বাদশার ফোন আসবে। তাদের ধন লাভের গোপন রহস্য শুনিয়ে অথবা মৃত্যু চিন্তায় অস্থিত মানুষ কখন পরবর্তী নির্দেশনা দিয়ে আশ্বস্থ করবে। কয়েক দিন বিরতি দিয়ে এভাবে আবারও ফোনে করে অনেক মানুষকে প্রলোভনে ফেলে কথিত এই জ্বীনের বাদশা। এই ফাঁদে আটকিয়ে অনেকের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় এই প্রতারক। অনেক মানুষ সরল বিশ্বাসে এই প্রতারকের ফাঁদে পড়ে পরবর্তী তার নির্দেশনা পেয়ে ছুটে যায় রাউজানের পরিবহন শ্রমিক বেলালের কাছে। ওসব মানুষের প্রতি বেলালের দাবি তার উপর অদৃশ্য ঐ জ্বীনের বাদশার ছওয়ার রয়েছে। দিনের পর দিন এভাবে প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকেই বিষয়টি টের পায়। এলাকার লোকজনের সাথে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া কথিত জিনের বাদশা মালেক প্রকাশ বেলাল অবশেষে বন্ধি হন পুলিশের খাচাঁয়।
প্রতারিতদের অভিযোগের ভিত্তিতে রাউজান থানা পুলিশ কৌশলে জীনের বাদশা খ্যাত বহুল আলোচিত এই মালেক বৈদ্যকে গ্রেপ্তারের পর গত শনিবার আদালতে সোর্পদ করা হয়। তাকে আদালতে হাজির করা হলে জামিন না মঞ্জুর করে জেল হাজতে প্রেরন করেন।
এ ব্যাপারে কথা বললে রাউজান থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ জানান, কথিত জিনের বাদশা আবদুল মালেক প্রকাশ বেলালের প্রতারনার শিকার হয়েছেন এমন অনেকেই থানায় অভিযোগ করার পর তাকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। ঘটনা উদঘাটনে সাত দিনের রিমাণ্ড চাওয়া হয়েছে।
জানা যায়, কথিত এই জ্বীনের বাদশা আবদুল মালেক ওরফে বেলাল চট্টগ্রামের রাউজান পৌর এলাকার ৭ নং ওয়ার্ডের শাহানগর এলাকার মৃত আনু মিয়ার পুত্র। আব্দুল মালেক এক সময়ে চাদেঁর গাড়ীর (জীপ) হেলপার হিসাবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। সে রাউজানের ডাবুয়া খোশাল তালুকদার বাড়ীর জাহনারা বেগম নামে এক নারীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। জাহানারা বেগমের গর্ভে চার কন্যা সন্তান জম্ম লাভ করেন । গত ৮ বৎসর পুর্বে আবদুল মালেক তার সহধর্মীনি জাহনারা বেগমের প্রবাসী ভাইয়ের স্ত্রী নিলু আকতারকে পরকিয়া প্রেমের ফাঁদে ফেলে ভাগিয়ে নিয়ে এসে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। নিলু আকতার পালিয়ে আসার সময় তার প্রবাসী স্বামীর রাখা কয়েক লাখ টাকা ও স্বর্ণালংকার অলংকার হাতিয়ে নিয়ে আসে। মালেক তার প্রথম স্ত্রী ও কন্যা সন্তান রেখে ২য় স্ত্রী নিলু আকতারকে নিয়ে রাউজান উপজেলা সদরে বাসা ভাড়া করে বসবাস করতে শুরু করেন ।
জানা যায়, সুচতুর কথিত এই জিনের বাদশা আবদুল মালেক গত কয়েক বৎসর ধরে এলাকার লোকজনকে গায়েবী স্বর্ণের ডেক (পাত্র) তোলে দিবে বা জীনের কবল থেকে রক্ষা করার কথা বলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে রাউজানের ছত্র পাড়া এলাকায় ২য় স্ত্রী নিলু আকতারের নামে জমি ক্রয় করে জমিতে বিলাসবহুল দ্বিতল বিশিষ্ট পাকা বাড়ী নির্মান করেন । বাড়ীটি মুল্যবান ফার্নিসার দিয়ে সাজানো হয়, বাড়ীতে এসিও লাগানো হয় । এই বাড়ীতে আবদুল মালেক তার দ্বিতীয় স্ত্রী নিলু আকতারকে নিয়ে বসবাস করতেন । এলাকার লোকজনের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া টাকায় দশটি সিএনজি, একটি প্রাইভেট কার, একটি মোটর সাইকেল ক্রয় করেন । কয়েকটি ব্যাংকে নিজের নামে ও তার ২য় স্ত্রীর নামে টাকা জমা রাখেন । জীনের বাদশা মালেক আটক হওয়ার পর ২য় স্ত্রী নিলু আকতার নিজের বিলাসবহুল পাকা ভবন ছেড়ে উধাও হয়ে যায় ।
জানা যায়, আব্দুল মালেক বেলাল নিজে জিনের বাদশা সেজেঁ বিভিন্ন উপায়ে এলাকার মানুষের সাথে দীর্ঘ কয়েক বছর যাবৎ প্রতারণা করে আসছিল। সে রাউজানের হাসান খীল এলাকার দর্জি ফোরকানকে বৈদ্য দিয়ে হলদিয়া ইউনিয়নের বটপুকুরিয়া মাজারের নিচ থেকে স্বর্ণের ডেক তোলে দেওয়ার কথা বলে দফে দফে ২৩ লাখ টাকা নেয় । একই ইউনিয়নের সুড়ঙ্গা এলাকার গ্রাম্য চিকিৎসক জয়ন্ত নাথের কাছ থেকে আদায় করেন ২২ লাখ টাকা । হলদিয়া বটপুকুরিয়া মাজারের শাহ আলম প্রকাশ শালুর কাছ থেকে আদায় করে ৮ লাখ টাকা, চন্দনাইশের সাতবাড়ীয়া এলাকার চন্দ্র মোহন নাথের কাছ থেকে সাত লাখ টাকা দুই ভরি ওজনের স্বর্ণলংকার হাতিয়ে নেয় । রাউজানের সুলতান পুর এলাকার ব্যবসায়ী শাহাদাৎ থেকে ২৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জয়ন্ত নাথ ও ফোরকান থেকে টাকা নিয়ে ক্লান্ত হয়নি জিনের বাদশা মালেক। জয়ন্ত নাথকে ও তার পরিবারকে জীনে মেরে ফেলবে বলে কথিত জিনের বাদশা মালেক বিভিন্ন মোবাইল সিম ব্যবহার করে নিজেই জিনের বাদশা সেজেঁ হুমকি দেয়। জয়ন্ত নাথ ও তার পরিবারকে রক্ষা করবে বলে কথিত জিনের বাদশা মালেক তার পৈতৃক ৩০ শতক জমি ২য় স্ত্রী নিলু আকতারের নামে রেজিষ্ট্রি করে নেয় । একই ভাবে ফোরকানের কাছ থেকে ও ৪৬ শতক জমি ২য় স্ত্রী নিলু আকতারের নামে রেজিষ্ট্রি করে নেয় কথিত জিনের বাদশা মালেক।
সর্বশেষ কথিত জিনের বাদশা আবদুল মালেক আবারো সাড়ে চার লাখ টাকা না দিলে জয়ন্ত নাথ ও ফোরকানকে জীনের কবল থেকে রক্ষা করতে পারবেনা বলে জানায়। জয়ন্ত ও ফোরকান কথিত জিনের বাদশা আবদুল মালেক প্রকাশ বেলালের প্রতারণা টের পেয়ে যায়। তারা জিনের বাদশাকে টাকা দেওয়ার কথা বলে রাউজান থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ পিপিএমের পরামর্শে ফাঁদ তৈরি করেন।
কথিত জিনের বাদশা আবদুল মালেক ফোনে টাকাগুলো তার বিলাসবহুল বাড়ীর পার্শ্বে মাওলানা অলিউল্লাহ শাহের মাজারে গত বুধবার রাতে রেখে আসতে বলে। ঐ স্থান থেকে জীনের বাদশা টাকা নিয়ে যাবে বলে জানায় কথিত জিনের বাদশা। জয়ন্ত নাথ ও ফোরকান সাদা কাগজের বান্ডিল প্যাকেট করে মাজারে রেখে কথিত জিনের বাদশাকে ফোনে জানিয়ে দেয়।
এসময়ে রাউজান থানার এস আই পরিতোষ দাশ সহ একদল পুলিশ সাদা পোষাকে মাজারের পার্শ্বে অবস্থান নেয়। গত বুধবার দিবাগত রাত ১০ টার সময় কথিত জিনের বাদশা আবদুল মালেক প্রকাশ বেলাল মাজারে প্রবেশ করে কাগজ মোড়ানো টাকার বান্ডিল নেওয়ার সময় পুলিশ আবদুল মালেক গ্রেফতার করেন।
প্রতারনার শিকার জয়ন্ত নাথ ও ফোরকান পৃথক পৃথক ভাবে কথিত জিনের বাদশা আবদুল মালেক প্রকাশ বেলালের বিরুদ্ধে রাউজান থানায় মামলা দায়ের করেছেন।
বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এডিটর ইন চিফ: আমিরুল ইসলাম আসাদ
বাড়ি#৩৫/১০, রোড#১১, শেখেরটেক, ঢাকা ১২০৭
ই-মেইলঃ [email protected]
ফোনঃ (০২) ৫৮১৫৭৭৪৪
নিউজ রুমঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯১
মফস্বল ডেস্কঃ ০১৫৫২৫৯২৫০২
বার্তা প্রধানঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯০
মার্কেটিং ও সেলসঃ ০৯৬১১১২০৬১২
ইমেইলঃ [email protected]

পাঠকের মন্তব্য: