
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমবারের মতো নিজ জেলা চট্টগ্রামে আসছেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রায় দেড় যুগ পর আসবেন গ্রামের বাড়ি বাথুয়া। তাকে স্বাগত জানাতে নেওয়া হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি।
বাথুয়া গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলা প্রকৌশলী কার্যালয়ের বাস্তবায়নে সদ্যনির্মিত হাজি মোহাম্মদ দুলা মিয়া সওদাগর সড়ক সৌন্দর্যবর্ধনের পাশাপাশি নুরালী বাড়ি উপ-ডাকঘর সংলগ্ন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পারিবারিক করবস্থানে চলছে চুনকামের কাজ।
এছাড়া পাশের মাঠও পরিষ্কার করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার বাবার পৈত্রিক নিবাস হাজি মোহাম্মদ দুলা মিয়া সওদাগর বাড়িতে হাটহাজারী উপজেলা ও পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নানা স্থাপনায় সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করছেন। বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক মো. জামসেদের জরাজীর্ণ ঘর ভেঙে তৈরি করা হচ্ছে নতুন ঘর। এছাড়া বাড়ির ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে বসানো হচ্ছে ভ্রাম্যমাণ শৌচাগার।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ড. ইউনূস চট্টগ্রামে পৌঁছানোর পর প্রথমেই চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শন করবেন। চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)-৫ প্রাঙ্গণে একটি বিশেষ মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়েছে। এই সভায় বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দর ব্যবস্থাপনা, কর্মক্ষমতা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং চলমান প্রকল্পগুলো নিয়ে একটি মাল্টিমিডিয়া উপস্থাপনা প্রদান করবে।
সভায় বন্দর ব্যবহাকারী বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধি,বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসায়ী নেতারা উপস্থিত থাকবেন। এছাড়াও বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা ও পরামর্শ পেতে আশাবাদী। এই বৈঠকে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরসহ অন্যান্য বৃহত্তর প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
পরবর্তীতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস থেকে৷ সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানে ড. ইউনূস চট্টগ্রাম শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো কালুরঘাট সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। এটি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী ও পটিয়া উপজেলার বিশাল জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। সেতুটি নির্মিত হলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক সহজ হবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের অনুরোধে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তরের ফলকে তার নাম উল্লেখ করা হবে না, এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
বিকেলে ড. ইউনূস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তনে যোগ দেবেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে আয়োজিত এই সমাবর্তনে প্রায় ২২ হাজার ৬০০ শিক্ষার্থী সনদ গ্রহণ করবেন। সমাবর্তনে বক্তা হিসেবে উপস্থিত থাকবেন ড. ইউনূস। এছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে সম্মানসূচক ‘ডি-লিট’ ডিগ্রি প্রদান করবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক হিসেবে ড. ইউনূসের এ সম্মাননা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
ড. ইউনূস ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যোগদান করেন এবং সেখানে দীর্ঘ সময় ধারে শিক্ষকতা করেন।
সমাবর্তন শেষে, ড. ইউনূস তার পৈতৃক বাড়ি হাটহাজারী উপজেলার শিকারপুর ইউনিয়নের বাথুয়া গ্রামে যাবেন। সেখানে তিনি তার দাদা-দাদির কবর জিয়ারত করবেন এবং আত্মীয়স্বজন ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করবেন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রায় দেড় যুগ পর ড. ইউনূস নিজের জন্মভূমিতে পা রাখছেন। সর্বশেষ ২০১৯ সালে তিনি চট্টগ্রামে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে এসেছিলেন, তবে তখন তিনি গ্রামের বাড়ি যাননি।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ড. ইউনূসের পরিবারের সবাই ৫০ থেকে ৬০ বছর ধারে নগরের পাঁচলাইশ থানাধীন নিরিবিলি নামক একটি ভবনে বসবাস করছেন। ১৯৪০ সালের ২৮ জুন তিনি বাথুয়া গ্রামের হাজী এম নজু মিয়া সওদাগর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। আট ভাই-দুই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়।
জোবরা গ্রামের প্রবীণ মুরুব্বি শামসু, কামাল উদ্দিন, শাহাব মিয়া, মোনাফ সওদাগরসহ অনেকেই জানান, ইউনূস আসবে বলে তাদেরসহ পুরো গ্রামবাসীর মধ্যে একটা অন্য রকম আনন্দ কাজ করছে। ঠিক ছোট বেলায় যেমন ঈদের আগেরদিন চাঁদরাতে আনন্দ অনুভূত হয় এখনও সেরকম আনন্দ বয়ে যাচ্ছে তাদের মধ্যে।
অপরদিকে প্রধান উপদেষ্টার পৈত্রিক বাড়ি নিজ জন্মস্থান বাথুয়া গ্রাম নিবাসী ফখরুল, কাশেম, জামাল মিয়াসহ একাধিক ব্যক্তি জানান, ‘ইউনূস সাহেব আমার এলাকার মানুষ। তিনার কারণে আজ আমাদের গ্রাম এলাকা পৃথিবীর বুকে পরিচিত। তিনি উপদেষ্টা হবার পর এই প্রথম আমাদের এলাকায় আসবেন, এযে কীরকম আনন্দের তা ভাষায় বলে প্রকাশ করতে পারবো না। প্রধান উপদেষ্টার আগমনের দিনটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন বলেও জানান তারা।’
হাটহাজারীর ইউএনও এ বি এম মশিউজ্জামান বলেন, ১৪ মে বিকেলে প্রধান উপদেষ্টা গ্রামের বাড়ি সংলগ্ন দাদা-দাদির কবর জেয়ারত করবেন এবং আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কুশলাদি বিনিময়ের কথা রয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) প্রকৌশলী মো. সবুক্তগীণ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস থেকে কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাট সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। আমাদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতারের নেতৃত্ব ও তত্ত্বাবধানে সমাবর্তন অনুষ্ঠান সফল করার জন্য আমরা সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। আমরা আশা করি, এই সমাবর্তন অনুষ্ঠানটি দেশের যেকোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সমাবর্তন হবে। কারণ এই জমকালো অনুষ্ঠানে যোগ দিতে প্রায় এক লাখ মানুষ ছবি ক্যাম্পাসে সমবেত হবেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছোট ছোট পাহাড় ও টিলাজুড়ে বিস্তৃত ২ হাজার ৩০০ একর জমির ওপর নির্মিত ক্যাম্পাসকে আরও সুন্দর ও মনোরম করে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস স্যার চট্টগ্রাম আসছেন। এটি দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষিত। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে কোন কর্মসূচি নেই। তবে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে রোড ডিভাইডারে রংকরণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, বিদ্যুতায়নসহ আমাদের বিভিন্ন কাজ চলছে।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ফরিদা খানম বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে চট্টগ্রামের জনগণ তাদের মাটির সন্তানকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার নিজ জেলায় বহুল প্রতীক্ষিত সফরটি সফল করতে আমরা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নির্দেশনা অনুসারে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছি।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর