
টিনের ছাউনি, কাদায় ভরা উঠোন, অন্ধকার ঘরে কেরোসিনের আলো—এই ছিল কনা আক্তারের শৈশব। সেই ঘর থেকেই উঠে এসেছেন জাতীয় হকি দলে। দারিদ্র্য, সামাজিক কটাক্ষ আর অভাবের পাহাড় ডিঙিয়ে কনা এখন বাংলাদেশের গর্ব। নাটোর জেলার বাগাতিপাড়ার সান্যালপাড়া গ্রামের বাসিন্দা কনা আক্তারের বাবা আবু বক্কর একজন দিনমজুর। মা চামেলী বেগম গৃহিণী। ছয় সদস্যের এই পরিবারের প্রতিদিনের জীবন চলে অতি কষ্টে। তিনবেলা খাবারই যেখানে নিশ্চিত নয়, সেখানে খেলাধুলা ছিল অচিন্তনীয়। তবুও থেমে থাকেননি কনা।
কনার বড় বোন বিনা একসময় ভালো ফুটবল খেলতেন। কিন্তু অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালেই বিয়ে হয়ে যায় তাঁর। কনার চোখে তখনই জন্ম নেয় জেদ—বোনের স্বপ্নটাকে একদিন সে পূরণ করবে। গোপনে অনুশীলন চালিয়ে যায় কনা। পাশে ছিলেন সান্যালপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কামরুল হাসান। ২০২১ সালে বিকেএসপির ট্রায়ালে অংশ নিতে রাজশাহী যায় সে। হকি, ফুটবল ও জিমন্যাস্টিকসে অংশ নিয়ে তিনটিতেই নির্বাচিত হয়। হকিতে প্রথম হওয়ায় সেটিই বেছে নেয়। তবে বিকেএসপিতে ভর্তি হতে প্রয়োজন ছিল ৩৫ হাজার টাকা। দিনমজুর বাবার পক্ষে এত টাকা জোগাড় করা অসম্ভব। তখন বিক্রি করা হয় পরিবারের শেষ সম্বল—ছাগল ও হাঁস। পাশাপাশি শিক্ষক কামরুল স্যারের সহায়তায় ভর্তি হয় কনা। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দুই বছরের মধ্যেই অনূর্ধ্ব-২১ হকি দলে জায়গা করে নেয় সে। খেলেছে সিঙ্গাপুর, ওমান এবং চীনে। ২০২৫ সালে চীনের দাজহুতে অনূর্ধ্ব-১৮ এশিয়া কাপ হকিতে অংশ নেয় কনা। সেখানে ৭টি ম্যাচের মধ্যে ২টিতে ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ নির্বাচিত হয়।
কনার মা চামেলী বেগম বলেন, “অনেকেই বলতো, মেয়ে খেলে কী হবে। বাধাও দিয়েছি। কিন্তু এখন মনে হয়, আমি ঠিক করিনি। মেয়েটাই আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে।” শিক্ষক কামরুল হাসান বলেন, “ওর চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। আমরা শুধু পাশে থেকেছি। তবে এখনো ওদের পরিবার খুব কষ্টে আছে। বিকেএসপিতে এক বছরের বেতন বাকি।” নিজের স্বপ্ন নিয়ে কনা বলে, “আমি চাই দেশের হয়ে আরও বড় পর্যায়ে খেলতে। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।” কনার গল্প প্রমাণ করে দেয় পরিশ্রম, ইচ্ছাশক্তি আর সঠিক দিকনির্দেশনা থাকলে কোনো অভাব বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। শুধু দরকার একটুখানি সাহস আর কারও সহযোগিতা।
সর্বশেষ খবর