
সাবেক এক সংসদ সদস্যের বাসায় চাঁদাবাজির অভিযোগে রাজধানীর গুলশান থেকে গ্রেপ্তার হওয়া আবদুর রাজ্জাক বিন সুলাইমান রিয়াদকে নিয়ে এখন সরগরম তার গ্রামের এলাকা। হঠাৎ করে পাকা ভবন নির্মাণ ও বিত্ত-বৈভবের প্রদর্শনীতে এলাকায় চলছে গুঞ্জন।
জানা গেছে, রিয়াদ নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার নবীপুর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের নবীপুর গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবা আবু রায়হান দিনমজুর। এক সময় রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। মা নাজমুন নাহার অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতেন। আর্থিক অনটনে বেড়ে ওঠা রিয়াদের হঠাৎ করে ঢাকায় দামি মোটরসাইকেল, গ্রামে নির্মাণাধীন একতলা পাকা ভবন এবং কথিত কোটি টাকার মালিক হওয়ায় নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে স্থানীয়দের মনে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রিয়াদ নবীপুর হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সরকারি মুজিব মহাবিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন। এরপর ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকেই তিনি কোটাবিরোধী আন্দোলন এবং পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ’-এর সমন্বয়ক হিসেবে তাকে বিভিন্ন জায়গায় সক্রিয় দেখা যায়। এরপর থেকেই এলাকায় তার উত্থান নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়।
নবীপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, রিয়াদের একতলা পাকা ভবনের নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আয়তন আনুমানিক ৯০০ থেকে ১,০০০ বর্গফুট। স্থানীয় এক প্রকৌশলীর মতে, এমন ভবনের নির্মাণে ব্যয় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার মতো হতে পারে। ছাদ ঢালাইসহ ইতোমধ্যেই ব্যয় হয়েছে প্রায় ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা।
ছেলে সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজি করেছেন রিয়াদের মা-বাবা তা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। রিয়াদের বাবা আবু রায়হান বলেন, আমি রিকশা চালিয়ে ছেলেকে বড় করেছি। আমরা না খেয়ে ওকে শহরে পাঠাইছি। টিভিতে দেখি আমার ছেলেকে পুলিশে ধরেছে। তার বোন জামাইরা মিলে এবার আমরা ৫৬ হাজার টাকায় একটা গরু কুরবানী দিয়েছি। বাড়ি নির্মাণে রিয়াদ আমাদের সহযোগিতা করেছে।
রিয়াদের মা রেজিয়া বেগম দাবি করেন, সরকার থেকে পাওয়া কিছু ঢেউটিন বিক্রি করে এবং ‘আল-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন’ থেকে পাওয়া ৫০ হাজার টাকা ও বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ নিয়ে এই ভবনের কাজ শুরু করেছেন। তবে স্থানীয়রা তার এই দাবিকে অবিশ্বাস করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রিয়াদের এক বন্ধু বলেন, রিয়াদের হাত অনেক লম্বা। সে সব সময় বড় বড় ছাত্র নেতাদের মেইনটেইন করতো। তার কাছ থেকে সুবিধাও নিতো। অনুসন্ধান করলে সবার নাম বেরিয়ে আসবে। রিয়াদ জুলাই আন্দোলনকে হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগিয়ে আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়ে গেছে। আমরা তার এবং মদদদাতাদের শাস্তি চাই।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল আলিম বলেন, মূলত জুলাই আন্দোলনে ভাগ্য খুলে যায় রিয়াদের। সমন্বয়ক পরিচয় যেন রিয়াদের আলাদীনের চেরাগ সে চেরাগ দিয়ে সে এখন আলিশান ভাবে চলাফেরা করেন। যেন মনে হয় সে এখন কোটিপতি! দামি বাইক কিনেছে, পাকা বাড়ি করছে। এমন ছাত্র হঠাৎ করে এত কিছু করছে—আমরা কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।
স্থানীয় বাজারের দোকানদার শরিফুল ইসলাম বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে রিয়াদের চলাফেরায় আমরা পরিবর্তন দেখতে পেয়েছি। অথচ ছাত্র জীবন থেকে সে মানুষের সাহায্য নিয়ে পড়াশোনা করেছে। ছাত্র রাজনীতি যদি দেশ গড়ার জায়গা হয়, তাহলে রিয়াদের মতো লোকদের তৎপরতা ভবিষ্যতের জন্য ভয়ংকর। এসব লোকই ছাত্র আন্দোলনকে কলুষিত করছে।
রিয়াদের সহপাঠী কোম্পানীগঞ্জের বাসিন্দা মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, রিয়াদ কৌশলে চলাফেরা করতো। তার চালচলনে কেউই বুঝবে না সে এত দরিদ্র পরিবারের সন্তান। কাদের মির্জার সঙ্গে ছবি তুলে সে তখন বড় নেতা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিত। বর্তমানে তার ফেসবুক আইডি বন্ধ দেখাচ্ছে। সঠিক তদন্ত করলে তার অনেক অনিয়ম বেরিয়ে আসবে।
প্রসঙ্গত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের উদ্যোগে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের। রিয়াদ এই ছাত্রসংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। চাঁদাবাজির ঘটনার পর তাকে পদ থেকে বহিষ্কারের তথ্য প্রচার করা হয়। এই সংগঠন হওয়ার আগে তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গত ফেব্রুয়ারিতে ঘোষিত সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছিল রিয়াদকে। গতকাল রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়া দেশের সব কমিটির কার্যক্রম স্থগিতের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে চাঁদাবাজির বিষয়টি ধরা পড়লে ফেসবুকে পোস্ট করা রিয়াদের বিভিন্ন ছবিও আলোচনায় আসে। তার ছবির ফ্রেমে আছেন কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতা। ফেসবুকে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ছবি পোস্ট করে নিজের শক্তির জানান দিতেন রিয়াদ।
বাঁধন/সিইচা/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর