
গত বছরের ৫ আগস্ট ভোরে আন্দোলনে অংশ নিতে বাড়ি থেকে বের হন মুন্না। কিন্তু সেই যে বের হলেন আর ফেরেননি তিনি। বছর ঘুরে আবারও দোরগোড়ায় ৫ আগস্ট। অথচ আজো ঘরে ফিরেননি মুন্না। বেঁচে আছে নাকি মারা গেছেন তাও জানে না তার বাবা-মা। এখনো অশ্রুসিক্ত নয়নে ছেলের অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছে মুন্নার মা বাবা ও একমাত্র ছোট বোন।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক দফা দাবিতে গত বছরের ৫ আগস্ট ঢাকার লং মার্চে গিয়ে আর ফিরে আসেননি সাব্বির হোসেন মুন্না (২৪)।
জুলাই আগস্ট আন্দোলনের যোদ্ধা মুন্না বেঁচে আছেন নাকি শহীদ হয়েছেন জানে না তার পরিবার। এখনও মুন্নাকে বিভিন্ন স্থানে খুঁজে বেড়াচ্ছেন স্বজনরা।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার কাঁচপুর ইউনিয়নের সোনাপুর এলাকায় আবু মুসা সরকারের বাড়ির পাঁচ তলায় ছোট্ট একটি রুম ভাড়া নিয়ে স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে গত চার বছর ধরে বসবাস করছিলেন মুন্নার বাবা শফিকুল ইসলাম।
সিদ্ধিরগঞ্জে একটি গার্মেন্টস কারখানায় স্বল্প বেতনে চাকরি করে একার উপার্জনে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন তিনি। তাই পরিবারের হাল ধরতে বাবার সাথে একই কারখানায় চাকরি নেন ২৪ বছর বয়সের একমাত্র ছেলে সাব্বির হোসেন মুন্না।
বাবা-ছেলে দুজনের আয়ে তাদের সংসারের খরচ চালানসহ মুন্নার ছোট বোন সুমাইয়ার লেখাপড়াও চলছিল একটি মহিলা মাদ্রাসায়। এ বছর দাখিল পরীক্ষায় অংশ নেবার কথা থাকলেও মুন্না নিখোঁজ হওয়ার পর বন্ধ হয়ে গেছে সুমাইয়ার লেখাপড়া। ভেঙে পড়েছে পুরো পরিবারটি।
মুন্নার মা মুক্তা বেগম জানান, গত বছর ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থান শুরু হলে কর্মস্থলে যাওয়ার সময় এলাকাবাসী ও বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নেন মুন্না। শেষ পর্যায়ে সারা দেশে টানা সরকারি ছুটি ও কারফিউ জারি করা হলে আন্দোলনের মাঠে মুন্না ছিলেন পুরোদমে। ৫ আগস্ট সকালে মাকে ফাঁকি দিয়ে শুধুমাত্র ছোট বোন সুমাইয়াকে জানিয়ে ঢাকার লং মার্চ কর্মসূচিতে কাঁচপুর থেকে মিছিলের সাথে গণভবনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন তিনি। এরপর আর বাড়িতে ফিরে আসেননি মুন্না।
ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে মা মুক্তা বেগম শোকে পাথর হয়ে গেছেন। কথা বলার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছেন। মোবাইল ফোনে মুন্নার ছবি দেখে দিন রাত চোখের পানি ফেলে কান্নায় বুক ভাসাচ্ছেন তিনি।
নিখোঁজ হওয়ার পর পরিবারের সদস্যরা রাজধানীর প্রায় সবগুলো হাসপাতাল, মর্গ ও থানায় খোঁজ করলেও নিখোঁজ মুন্নার সন্ধান মেলেনি আজও। এ ঘটনায় মুন্নার পরিবার গত ১৮ আগস্ট সোনারগাঁ থানায় জিডি করেন। এরপর জিডির কপি নিয়ে আড়াইহাজার সেনাবাহিনীর ক্যাম্পেও লিখিতভাবে বিষয়টি জানান। তবে আজ অবধি মুন্নার কোন হদিস পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় মুন্না বেঁচে আছে নাকি আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন তা জানেন না তারা।
অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে মুন্নার বাবা বলেন, “ছেলে বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে জানি না। ছেলের লাশটাও যদি পেতাম তাহলে নিজের হাতে দাফন করে মনকে অন্তত সান্ত্বনা দিতে পারতাম। আমার একটা মাত্র ছেলে। আমি মরে গেলে আমাকে মাটি দেওয়ার মতো পরিবারে আর কেউ নাই।”
এদিকে, জেলা প্রশাসনের তৈরি গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের তালিকায় পাওয়া যায়নি মুন্নার নাম। নেই আহতদের তালিকায়ও। তবে কি মুন্না এখনও পড়ে আছে হাসপাতালের কোন হিমাগারে? নাকি ঠাঁই হয়েছে অজ্ঞাত শহীদদের কোন গণকবরে? এমন প্রশ্ন তুলেছেন নিখোঁজ মুন্নার পরিবারসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নারায়ণগঞ্জ জেলা সদস্য সচিব মো. জাবেদ আলম বলেন, “আন্দোলনে অংশ নেয়া স্থানীয় ছাত্রদের কাছ থেকে আমরা মুন্নার নিখোঁজের বিষয়টি জানতে পারি। পরে তার বাসায় গিয়ে পরিবারের সঙ্গে কথা বলি। আমরাও আমাদের অবস্থান থেকে বিভিন্ন ভাবে খোঁজ করেছি। জেলার শহীদ ও আহতদের তালিকাও দেখেছি। কোথাও মুন্নার নাম পাইনি। আমরা আশা করব সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো বিষয়টি গুরুত্ব দেবে এবং মুন্নার সন্ধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।”
বাঁধন/সিইচা/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর