
একজন মানুষ আর নেই। আরেকজন শুয়ে আছে হাসপাতালের বিছানায়, পা থেঁতলানো, কষ্টে আর্তনাদ করছে। তারা কেউ অপরাধী নয়। শুধু সত্য বলার সাহস দেখিয়েছিল। তাঁদের নাম ছিল আসাদুজ্জামান তুহিন আর একজন আনোয়ার হোসেন। একজন রক্তাক্ত হয়ে নিভে গেলেন সমাজ থেকে, আরেকজনের ভবিষ্যত আজ অনিশ্চয়তার মেঘে ঢাকা।
তাঁরা ছিলেন সংবাদকর্মী—সত্যের পাশে দাঁড়ানো মানুষেরা। কিন্তু সত্য বলার অপরাধে আজ তাঁরা ভুক্তভোগী। নিঃশব্দ চিৎকারে তাদের বেদনাকে আমরা কি শোনা থেকে বঞ্চিত থাকবো? তুহিন আজ নেই। কিন্তু তার সাহস আমাদের কাছে এক অনুরোধ, এক বেদনার গল্প। আনোয়ার আজ বাঁচার লড়াই করছে।
সাংবাদিকতা কখনোই কেবল পেশা নয়—এটি দায়িত্ব, চ্যালেঞ্জ আর সমাজের আয়না তুলে ধরার নিরন্তর সংগ্রাম। কিন্তু সেই আয়নার প্রতিফলন যদি রক্তে রঞ্জিত হয়, যদি সত্য বলার অপরাধে একজন সংবাদকর্মী প্রাণ হারান, আর আরেকজন দেহে ইটের থেঁতলে দেওয়া ক্ষত নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় ছটফট করেন—তবে আমাদের সামনে এক ভয়ংকর প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়: সাংবাদিকরা কি এখন সমাজে সবচেয়ে অনিরাপদ?
সাহসী প্রতিবাদের নির্মম সমাপ্তি তুহিন: গাজীপুরে ঘটে গেছে এক রোমহর্ষক ঘটনা। ‘প্রতিদিনের কাগজ’-এর গাজীপুর ব্যুরো প্রধান আসাদুজ্জামান তুহিনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে স্থানীয় সাংবাদিক পলাশ প্রধান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘এক নারী ছিনতাইয়ের শিকার হলে তুহিন সেই দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করেছিলেন। সেটাই হয়তো তার অপরাধ।’ দুর্বৃত্তরা তার পিছু নেয়, এবং সুযোগ বুঝে তাকে পাশের এক মার্কেটের সামনে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে। এটি নিছক কোনো হত্যাকাণ্ড নয়—এটি নির্মম প্রতিশোধ, বেছে নিয়ে টার্গেট করা এক ভয়ংকর বার্তা; মুখ বন্ধ রাখতে ভয়ের রক্তচাপ!
বেঁচে থাকলেও রক্তাক্ত এক বার্তা দিচ্ছে আনোয়ার: অন্যদিকে, আরেক সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন—দৈনিক বাংলাদেশের আলো-এর প্রতিনিধি, তাকেও রেহাই দেয়নি সন্ত্রাসীরা। জয়দেবপুর এলাকায় সরকারি জায়গায় অবৈধ দোকান গড়ে তোলা নিয়ে রিপোর্ট করায় তার ওপর চড়াও হয় দুর্বৃত্তরা। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, আনোয়ারকে টেনেহিঁচড়ে রাস্তার মধ্যে ফেলে ইট দিয়ে পা থেঁতলে দেওয়া হয়। বুকের ওপর লাফিয়ে পা ভেঙে দেওয়ার মতো নৃশংসতা এই সময়ে কল্পনাও করা কঠিন।
এই দুই ঘটনা কি বিচ্ছিন্ন? এখানে আমাদের ভাবতে হবে, এ ঘটনা দুটি কি নিছকই বিচ্ছিন্ন, নাকি একটি ধারাবাহিক আতঙ্কের অংশ? দুর্বৃত্তরা যদি বুঝতে পারে—একজন সাংবাদিকের প্রতিবাদের ফল হতে পারে মৃত্যু বা পঙ্গুত্ব, তবে তারা উৎসাহিত হবে। আর সমাজ যদি চুপ থাকে, তাহলে আমরা অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাব।
মানবিকতা ও পেশাগত নিরাপত্তা—দুইয়েরই প্রশ্ন: তুহিনকে খুন করা হয়েছে তার পেশাগত দায়িত্ব পালনের কারণে। আনোয়ারকে পা থেঁতলে দেওয়া হয়েছে অবৈধ দখলের প্রতিবাদ করার কারণে। এই দুইজন সাংবাদিকের ওপর হামলা আমাদের পেশাগত স্বাধীনতার প্রশ্ন তোলে। তারা কোনো অপরাধী ছিলেন না। তারা ছিলেন সমাজের ‘চোখ’ ও ‘জানালা’। কিন্তু এখন সেই চোখ উপড়ে ফেলা হচ্ছে, সেই জানালায় তালা মারা হচ্ছে।
প্রতিরোধ গড়ে না তুললে, পরবর্তী শিকার কে? এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে—সাংবাদিকরা আর কতোদিন এভাবে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করবেন? তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কেবল পেশাগত দাবি নয়—এটি একটি সমাজের ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার সূচক।
তুহিন-আনোয়ারের রক্ত আজ প্রতিরোধের আহ্বান: তুহিন আজ নেই। কিন্তু তার দেখানো সাহস, তার প্রতিবাদী মানসিকতা, আমাদের জন্য এক আহ্বান। সত্যকে রক্ষা করতে হলে, সত্য বলার মানুষদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, ন্যায়ের পক্ষে সমাজকে দাঁড়াতে হবে। আনোয়ার বেঁচে থাকলেও, তার পায়ের ক্ষত বয়ে বেড়াবে আমাদের ব্যর্থতার চিহ্ন।
সাংবাদিক তুহিনের রক্ত, আনোয়ারের থেঁতলে যাওয়া পা—এই দুইয়ের চিহ্ন যেন বিফলে না যায়। এটাই হোক আমাদের সম্মিলিত অঙ্গীকার।
রার/সা.এ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর