
উত্তরাঞ্চলের মানুষ কত বছর অপেক্ষা করেছে এই সেতুর জন্য। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, নদীর ঢেউয়ের ব্যথা, ফেরি-নৌকার ভোগান্তি, দূরত্বের অসহ্য যাতনা—সবকিছুর মাঝেই বুকের ভেতরে লালন করেছে একটাই স্বপ্ন, একটাই আকাঙ্ক্ষা। স্বপ্ন ছিল একটি সেতুর, যা কেটে যাবে নদীর বিভাজন, মিলিয়ে দেবে কুড়িগ্রাম- গাইবান্ধার বিচ্ছিন্নতা, ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবে আশা।
‘মাওলানা ভাসানী সেতু’—এই নামের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল উত্তরের মানুষের কোটি আশা, হাজারো স্বপ্ন। উদ্বোধনের দিন তাই ছিল এক অবর্ণনীয় আনন্দের। মানুষের চোখে ঝলমল করছিল উচ্ছ্বাস, হৃদয়ে বাজছিল মুক্তির সুর। মনে হচ্ছিল—এবার আর ফেরি বা নৌকায় অপেক্ষা নয়, আর নয় নদী পার হওয়ার ঝুঁকি। সেতুটি যেন হয়ে উঠল জীবনের নতুন শ্বাস, নতুন গতিশীলতা।
এই সেতু শুধুই দূরত্ব কমাবে না, এটি ছিল উত্তরের মানুষের আশা, তাদের জীবনের নতুন দিশা। স্রেফ যাতায়াত সহজ করার নয়, এটি হবে অর্থনীতির সেতু, ব্যবসায়ী, কৃষক, শিক্ষার্থী, যাত্রী—সবাই যেন সুবিধা পায়। কিন্তু একের পর এক চুরি, রিফ্লেক্টর লাইট ও বৈদ্যুতিক তারের উধাও—এই স্বপ্নের সেতুকে কি নিরাপত্তাহীনতার কাছে ধ্বংস হতে দেওয়া হচ্ছে?
কিন্তু সেই আনন্দ টিকলো কয় দিন? উদ্বোধনের দ্বিতীয় রাতেই খবর এলো— সেতুর ৩১০ মিটার বৈদ্যুতিক তার খোয়া গেছে। কোটি কোটি টাকার সেতু হঠাৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো। অন্ধকার সেতুতে ঝুঁকি নিয়ে চলতে হলো পথচারী ও যানবাহনকে। দুর্ঘটনার ভয় ঘিরে ধরলো প্রতিটি মানুষকে। কারও চোখে আনন্দের আলো, মুহূর্তেই পরিণত হলো আতঙ্কের অন্ধকারে। এখন প্রশ্ন হলো—এই কোটি কোটি টাকার গর্ব, উত্তরের মানুষের আশা, কীভাবে রক্ষা করা হবে অন্ধকারের থাবা থেকে?
আনন্দের মুহূর্তে রক্তক্ষরণ: প্রথম আঘাত সামলে উঠতে না উঠতেই এলো মর্মান্তিক খবর—আলোহীন সেতুতে ঘটে গেল সড়ক দুর্ঘটনা। একজন প্রাণ হারালেন। এই মৃত্যুর রেশ কাটতে না কাটতে আবারও পত্রিকার পাতায় ভেসে এলো এই সেতুতে সড়ক দূর্ঘটনার খবর। গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে হাসপাতালের শয্যায় কাতরাচ্ছেন দুজন। এ যেন আনন্দের ভেতর হঠাৎ ঝড়ে ভেঙে পড়া বজ্রপাত। উদ্বোধনের আনন্দমুখর মুহূর্তই পরিণত হলো শোক ও হতাশার আবরণে।
আবারও দুর্বৃত্তের থাবা: মানুষ যখন ভাবছিল—আবার হয়তো সব স্বাভাবিক হবে, আবার আলো জ্বলবে, তখনই এলো আরেক দুঃসংবাদ। সেতুর রিফ্লেক্টর লাইট উধাও। কতগুলো লাইট খোয়া গেছে, তা এখনও পরিষ্কার নয়। কিন্তু প্রশ্ন একটাই—৯২৫ কোটি টাকায় নির্মিত এ সেতুর নিরাপত্তা ব্যবস্থা এতটাই ভঙ্গুর কেন, যে বারবার খোয়া যাচ্ছে সরকারি সম্পদ?
জনমনে ক্ষোভ ও হতাশা: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে গ্রামের চায়ের দোকান—সবখানেই এখন আলোচনা ভাসানী সেতু নিয়ে। মানুষ বলছে—যে সেতু আলোকোজ্জ্বল হওয়ার কথা ছিল, সেই সেতু ঘিরেই এখন অন্ধকার, শঙ্কা আর ক্ষোভ। প্রতিদিন হাজারো মানুষ সেতুতে আসছে, দেখছে, হতাশ হচ্ছে। অনেকের কণ্ঠে প্রশ্ন—“এ সেতু কি তবে অব্যবস্থাপনা আর নিরাপত্তাহীনতার প্রতীক হয়ে যাবে?”
যে প্রশ্ন এড়ানো যায় না: মাওলানা ভাসানী সেতু কেবল একটি সেতু নয়—এটি উত্তরাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন। এখানে বিনিয়োগ হয়েছে বিপুল অর্থ, জড়িয়ে আছে কোটি মানুষের আশা। অথচ উদ্বোধনের কয়েক দিনের মধ্যে বারবার এমন ঘটনা ঘটছে, যা মানুষের মনে শুধু হতাশা আর ক্ষোভ তৈরি করছে।
এখন প্রশ্ন? — • কোটি কোটি টাকার এ প্রকল্প যদি আলো নিভিয়ে, দুর্ঘটনা ঘটিয়ে, বারবার খোয়া যাওয়ার গল্প তৈরি করে—তাহলে কি এটি স্বপ্ন পূরণের সেতু, নাকি অব্যবস্থাপনার প্রতীক? • এভাবে চলতে থাকলে মানুষ কি আর আস্থা রাখতে পারবে?
সময়ের দাবি: অবস্থা যেমন চলছে, তা আর চলতে দেওয়া যাবে না। ভাসানী সেতুর নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবা জরুরি। আলো জ্বালানো জরুরি। পথচারী ও যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। মানুষের আশা–স্বপ্ন–ভরসা যদি ভেঙে যায়, তবে এই সেতু আর স্বপ্নের সেতু থাকবে না, পরিণত হবে ‘হতাশার সেতুতে’।
লেখক: রাশেদুল ইসলাম রাশেদ
সাংবাদিক ও শিক্ষক
রার/সা.এ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর