
বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সংকট সমাধান এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করতে আয়োজিত তিন দিনের আন্তর্জাতিক সংলাপ শেষ হলো কক্সবাজারে। মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) সকালে সমাপনী দিনে উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন ৪০ দেশের কূটনীতিক ও প্রতিনিধিসহ দেশি-বিদেশি অংশগ্রহণকারীরা।
সকালে দুই দলে ভাগ হয়ে প্রতিনিধিরা উখিয়ার ক্যাম্প- ৪ এ যান। সেখানে জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) পরিচালিত ই-ভাউচার আউটলেট কেন্দ্র ঘুরে দেখেন। পরে তারা বালুখালী ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল ও রোহিঙ্গা নারীদের হস্তশিল্প প্রশিক্ষণকেন্দ্র পরিদর্শন করেন। প্রতিনিধিরা রোহিঙ্গা নারী- পুরুষের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের দুঃখ- দুর্দশা শোনেন। দুপুরে পরিদর্শন শেষে ক্যাম্প এলাকা ত্যাগ করেন।
গত রবিবার থেকে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এই সংলাপের শিরোনাম ছিল ‘স্টেকহোল্ডারস’ ডায়ালগ; টেকঅ্যাওয়ে টু দ্য হাই-লেভেল কনফারেন্স অন দ্য রোহিঙ্গা সিচুয়েশন’। উদ্দেশ্য ছিল রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধান খুঁজে বের করা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা বাড়ানো। সম্মেলনে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী, দাতা দেশ, মানবাধিকারকর্মী ও গবেষকরা অংশ নেন।
সংলাপের দ্বিতীয় দিনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট কোনোভাবেই বাংলাদেশের একার পক্ষে সমাধান সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে।’ তিনি কক্সবাজারের ইনানীতে আয়োজিত সেশনে উল্লেখ করেন, রোহিঙ্গাদের দীর্ঘমেয়াদি উপস্থিতি বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত চাপে ফেলছে। সমাধান কেবল বৈশ্বিক সহযোগিতার মাধ্যমেই সম্ভব।
এদিকে সংলাপ চলাকালেই সীমান্ত দিয়ে নতুন করে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের খবর পাওয়া গেছে। স্থানীয় প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, শুধু আগস্টেই কয়েক হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজার ও বান্দরবানের সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। এর মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, এ অবস্থায় প্রত্যাবাসন আলোচনাও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশ সরকার বারবার বলছে, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনই একমাত্র সমাধান। তবে মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নিরাপত্তাহীনতা ও আন্তর্জাতিক মহলের উদাসীনতায় এ প্রক্রিয়া আটকে আছে। সম্প্রতি চীন ও আসিয়ানভুক্ত কয়েকটি দেশ প্রত্যাবাসনে নতুন উদ্যোগ নিলেও কার্যত কোনো অগ্রগতি হয়নি। সংলাপে অংশ নেওয়া বিদেশি প্রতিনিধিরা রোহিঙ্গা সংকটকে ‘আঞ্চলিক নিরাপত্তার হুমকি’ হিসেবে চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধানে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
আন্তর্জাতিক সংলাপ ঘিরে কক্সবাজারে নেওয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিদেশি প্রতিনিধিদের সফরকে কেন্দ্র করে পুরো জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয় এবং অস্ত্র আইন অনুযায়ী বিশেষ নির্দেশনা কার্যকর থাকে। জেলার বিভিন্ন স্থানে বিজিবি, পুলিশ ও র্যাবের বাড়তি চৌকি বসানো হয়।
কক্সবাজারের ও টেকনাফ- উখিয়া অঞ্চলের স্থানীয় জনগণ মনে করছেন, রোহিঙ্গাদের দীর্ঘমেয়াদি অবস্থান তাদের জীবিকা ও নিরাপত্তায় বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় রাজনীতিতেও রোহিঙ্গা কার্ড ব্যবহারের অভিযোগ উঠছে। মাদক চোরাচালান, মানবপাচার, অবৈধ ব্যবসা ও ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গাদের নাম ওঠানো নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে। সম্মেলনের বাইরে স্থানীয় সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সাংবাদিকেরা বলেন, শুধু আলোচনায় সমস্যার সমাধান হবে না, দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে।
সংলাপে অংশ নেওয়া মানবাধিকারকর্মীরা জানান, রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক তহবিলে ঘাটতি দেখা দেওয়ায় খাদ্য, চিকিৎসা ও শিক্ষা কার্যক্রম সংকুচিত হচ্ছে। এ কারণে ক্যাম্পে অপরাধ প্রবণতা ও হতাশা বাড়ছে। তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জরুরি সহায়তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান।
তিন দিনের সংলাপ শেষে আয়োজকেরা জানান, এখানে প্রাপ্ত সুপারিশগুলো আগামী সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অধিবেশনের সময় আলোচনায় তোলা হবে। তারা আশা করছেন, এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গা ইস্যুতে নতুন করে আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগাড় করা সম্ভব হবে।
রোহিঙ্গাদের মতে, আট বছর ধরে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা এখনো প্রত্যাবাসনের অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। তাদের দুঃখ- কষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদি অবস্থান বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। কক্সবাজারে শেষ হওয়া এই আন্তর্জাতিক সংলাপের মধ্য দিয়ে নতুন করে আলোচনার দরজা খুললেও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাশা একটাই- নিজেদের ঘরে ফেরার নিশ্চয়তা।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর