
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শুধু প্রতিনিধি দিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার বিধান রাখছে না নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এক্ষেত্রে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় প্রার্থী বা প্রস্তাবকারীর উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)-এ সুপারিশ রেখেছে সংস্থাটি।
ইসি সূত্র জানায়, আগের আইন অনুযায়ী কোনো প্রার্থীর পক্ষে যে কেউ চাইলে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারত। কিন্তু নতুন এ বিধানের ফলে প্রার্থী বা তার প্রস্তাবকারী/সমর্থনকারীকে সশরীরে রিটার্নিং বা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া বাতিল করা হয়েছে অনলাইন মনোনয়নপত্র জমা দানের বিধান।
প্রার্থীদের জামানত ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে আরপিওতে।
জানা যায়, কয়েক দফা কমিশন বৈঠক করে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)-এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে ইসি। যা গত মঙ্গলবার (০২ সেপ্টেম্বর) ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে। এরপর উপদেষ্টা পরিষদ সভায় তা অনুমোদন হলে অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হবে।
আরপিও-এর বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাউসদ (আব্দুর রহমান মাসউদ?) বলেন, সমভোটে লটারির পরিবর্তে পুনঃনির্বাচন, একক প্রার্থিতায় 'না' ভোট, অনিয়মে পুরো আসনের ভোট বাতিল, জোট করলেও নিজ দলের প্রতীকে ভোট, ঋণখেলাপি প্রমাণিত হলে ভোটের পরেও পদ বাতিল, প্রবাসীদের অনলাইনে পোস্টাল ভোটের নিবন্ধনসহ তিন ডজনের বেশি প্রস্তাব করা হয়েছে।
তিনি জানান, প্রার্থী হতে শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত রাখা হয়নি। একক প্রার্থিতায় 'না' ভোটে ডামি প্রার্থী বাড়তে পারে—এমন আশঙ্কা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগে একক প্রার্থী হলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতো, এখন তাকে 'না' ভোটের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে হবে।
আরপিওতে যত সংশোধন প্রস্তাব রাখল ইসি:
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় বিদ্যমান বাহিনীর পাশাপাশি সশস্ত্রবাহিনী (সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী) এবং কোস্টগার্ডকে রাখা হয়েছে।
ইভিএম সংক্রান্ত যাবতীয় প্রভিশন বিলুপ্ত করা হয়েছে।
নির্বাচন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের অবহেলাজনিত যে শাস্তিগুলো আছে সেগুলো সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। এটা তিন কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করে ইসিকে জানাতে হবে।
'না' ভোটের বিধান করা হয়েছে শুধু একক প্রার্থীর আসনে। 'না' ভোটের বিধানটা হবে যদি কোথাও একজন প্রার্থী হয়; বিনা ভোটে নির্বাচিত হবে না। সার্বিকভাবে 'না' ভোট নয়।
নির্বাচন কমিশনের অনুমতিপ্রাপ্ত পর্যবেক্ষক এবং সংবাদকর্মীদের কেন্দ্রে প্রবেশের বিধান যুক্ত করা হয়েছে আরপিওতে।
ফলাফল স্থগিত ও বাতিল নিয়ে যে বিধানগুলো ছিল যেখানে পুরো আসনের নির্বাচন বাতিল বা ফলাফল বাতিল করার যে সক্ষমতা সেটাকে সীমিত করা হয়েছিল। সেটা আবার পুনঃস্থাপন করা হয়েছে। অর্থাৎ (অনিয়ম হলে) নির্বাচন কমিশন অবস্থা বুঝে নির্বাচন স্থগিত করা এক বা একাধিক বা সমস্ত আসনের একইভাবে ফলাফল এক বা একাধিক বা সমস্ত আসনের ফলাফল বাতিল করতে পারবে।
আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য শাস্তি কার্যকরের বিধান সেটা সন্নিবেশ করা হয়েছে। অর্থাৎ আরপিওতে এটার বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
সংবাদমাধ্যম কর্মীরা ভোট গণনার সময় উপস্থিত থাকতে পারবে। তবে শর্ত - গণনা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যারা থাকতে চাইবেন তাদেরকে পুরাটা সময়ব্যাপী থাকতে হবে। মাঝপথে বের হয়ে যাওয়া যাবে না।
সমভোট প্রাপ্তদের জন্য আগে লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত ঘোষণার বিধান বাদ দিয়ে পুননির্বাচনের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। যদি সমান হয়ে যায় তাহলে লটারির মাধ্যমে প্রার্থী নির্বাচনের যে বিধান ছিল কমিশন সেটা থেকে সরে এসে বলছে এক্ষেত্রে পুনঃনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
বিলবোর্ডে শুধু যেগুলো ডিজিটাল বিলবোর্ড সেগুলোতে আলোর ব্যবহার করা যাবে। বিদ্যুতের ব্যবহার করা যাবে। তাছাড়া আলোকসজ্জার ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে।
প্রার্থীদের এ ব্যয়ের অডিটের ব্যাপারটাকে আরো সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে এবং আরেকটু একনিষ্ঠভাবে দেখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে এই ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন যেগুলো ব্যত্যয় মনে করা হবে সেগুলোকেই অডিট করবে।
ইতোপূর্বে রাজনৈতিক দলগুলো ব্যক্তি পর্যায় থেকে ১০ লাখ পর্যন্ত এবং প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ৫০ লাখ পর্যন্ত অনুদান বা ডোনেশন নিতে পারত। এটাকে উভয়ক্ষেত্রে লাখ টাকা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে এই লেনদেন হতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আয়কর রিটার্নে এটা দেখাতে হবে।
নির্বাচন ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পৃক্ত থাকেন বিশেষ করে পুলিশ এবং প্রশাসনের যাদের বদলি তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ১৫ দিন পর পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে করতে হয়। সেখানে সংশ্লিষ্ট রেঞ্জের ডিআইজিদের অন্তর্ভুক্তি ছিল না, সেটা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-এআই ইত্যাদি ব্যবহার করে যেকোন ধরনের মিথ্যাচার বা অপবাদ ছড়ানো ইত্যাদি ব্যাপারে প্রার্থী দল সংস্থা মিডিয়া সংস্থা সবার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান করা হয়েছে।
কোনো রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দরখাস্ত যদি নাকচ হয় তাহলে ১৫ দিনের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করেই নির্বাচন কমিশন তাদেরকে পত্র দিবে। অতীতে শুধুমাত্র নাকচ করে চিঠি দেওয়া হতো এবং এই চিঠিটা আদালতে তারা উপস্থাপন করতে পারতেন এবং আদালতে এই কারণগুলো যথাযথভাবে প্রদর্শিত না হওয়ার কারণে অনেকে আবার নিবন্ধন ফেরত পেতেন। ইসি সিদ্ধান্ত নিয়েছে-এতে প্রতিটি কারণ যথাযথভাবে উল্লেখ রাখা হয়েছে।
কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম স্থগিত হলে বা নিষিদ্ধ হলে, নিবন্ধন স্থগিত করার বিষয়টি অস্পষ্ট ছিল। এটা স্পষ্ট করে আরপিওতে যোগ করা হয়েছে।
হলফনামায় যদি মিথ্যা তথ্য দেয় তাহলে সেটার ব্যাপারে তদন্ত করে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য আরো সুনির্দিষ্টভাবে আরপিওতে সন্নিবেশ করা হয়েছে। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও (৫ বছর মেয়াদে) এই সময়কালে যদি হলফনামায় কোনো ধরনের অত্যুক্তি, বিচ্যুতি, মিথ্যা তথ্য যদি হয় তাহলে তদন্ত করে প্রয়োজনে তার প্রার্থীতা বাতিল করা হবে এবং নির্বাচিত এমপি হলেও আইনের আওতায় আসতে পারেন। এবং তার পদ চলে যেতে পারে। তবে এই পাঁচ বছরের পরে তা নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারের মধ্যে থাকবে না।
প্রিজাইডিং অফিসারদের ক্ষমতা বাড়ানো, ভোটে প্রভাব খাটালে শাস্তিসহ অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে একগুচ্ছ সুপারিশ রয়েছে। তবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সুষ্ঠু ভোটে 'সার্টিফিকেট' দেওয়া, ইসির জবাবদিহিতা সংক্রান্ত কিছু সংস্কার সুপারিশ ইসির প্রস্তাবে থাকছে না।
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করার লক্ষ্যে সকল প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। ইতোমধ্যে রোডম্যাপও ঘোষণা করেছে সংস্থাটি। সে অনুযায়ী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আইনি সংস্কার চূড়ান্ত করবে ইসি।
সর্বশেষ খবর