
রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ধানমন্ডি থেকে অভিনেত্রী ও নির্মাতা মেহের আফরোজ শাওনকে গ্রেপ্তারের ঘটনাটি ছিল মাত্র একটি পর্ব। বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) গভীর রাতে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) তাকে আটক করে নিয়ে গেলেও, স্বল্প সময়ের মধ্যেই তার মুক্ত হয়ে আসা এবং পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে একের পর এক তীক্ষ্ণ ও ইঙ্গিতপূর্ণ পোস্ট দেওয়া— এসব ঘটনা প্রমাণ করে যে শাওন এক অসাধারণ প্রভাবশালী এবং তার পেছনে রয়েছে এক অদৃশ্য, কিন্তু অদম্য শক্তি।
গ্রেপ্তার কেবলই নাটক? ক্ষমতাধর শাওনের ইশারা!
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) রেজাউল করিম মল্লিক রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের অভিযোগে শাওনকে গ্রেপ্তারের কথা জানালেও, এই গ্রেপ্তারের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই তার মুক্তি প্রমাণ করে, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলির চেয়েও বড় কোনো প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপ ছিল এই প্রক্রিয়ায়। নেটিজেনদের ধারণা, আওয়ামী লীগে তাকে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাকে রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের কৌশল হিসেবে ব্যবহারের জন্য। কিন্তু বাস্তবে তিনি যেন এই ব্যবস্থাকেই নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনের মঞ্চ বানিয়ে তুলেছেন।
ফেসবুকের কুরুক্ষেত্র: শাওনের প্রতিটি পোস্টই যেন ‘ক্ষমতার বার্তা’
মুক্তির পরপরই শাওন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফিরে আসেন আরও বেপরোয়া রূপে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে বর্তমান সরকারকে লক্ষ্য করে দেওয়া তার প্রতিটি পোস্টই যেন শক্তিশালী খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তির ঠান্ডা মস্তিষ্কের ব্যাঙ্গ। তার কটাক্ষের ভাষা তীক্ষ্ণ, ইঙ্গিতপূর্ণ এবং দুঃসাহসী, যা কোনো সাধারণ ব্যক্তির পক্ষে বর্তমান পরিস্থিতিতে দেওয়া অসম্ভব।
তার কিছু বিতর্কিত পোস্টের অংশবিশেষ, যা তার ক্ষমতার গভীরতার ইঙ্গিত দেয়:
৫ই আগস্টের কটাক্ষ: "ভরা বর্ষায় সাগরের উত্তাল রূপ দেখতে আমারও দল বেঁধে ‘ককসোবাজার’ যেতে খুব ইচ্ছা করছিল, কিন্তু আজ তো জুলাইয়ের ৪০১ তারিখ পালন করতে হবে- তাই গেলাম না। অথচ… ?"
৩২ নম্বর নিয়ে রহস্য: "পুড়িয়ে ও গুড়িয়ে দেয়ার পরও যে বাড়ি পাহারা দিতে হয় সে বাড়ির নাম '৩২ নম্বর'।"
উসকানিমূলক ইঙ্গিত: জুলাই যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে তার বিতর্কিত 'সময়রেখা' অ্যালবামের পোস্ট, যেখানে তিনি লিখেছিলেন— ‘বাচ্চারা এত্ত ভয় পেয়েছে?’— এটি ডিলিট করার পরও তার সেই বক্তব্যই বহাল রয়েছে।
সাম্প্রতিক বিদ্রূপ: 'ভিপি নূর' বা 'পিপিনুল' নিয়ে তার মন্তব্য এবং 'লিটনের ফ্ল্যাট' বা 'নেপালি কালচারাল ফ্যসিস্ট'-এর মতো পোস্ট— প্রতিটিই যেন ক্ষমতার দম্ভে প্রকাশ করা হচ্ছে।
পাহাড়ে আগুন নিয়ে তির্যক মন্তব্য: "কিন্তু ‘উমেহ্লা’র কান্না আর তার বাবার অসহায় দৃষ্টি আমাদের ভালো লাগে না। তাই আমরা পাহাড়ে আগুন দেই। #গুইমারি"
তার এই ধরনের স্পষ্ট এবং আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেখে প্রশ্ন উঠেছে— মেহের আফরোজ শাওনের পেছনে ঠিক কোন শক্তি কাজ করছে?
পারিবারিক পটভূমি ও 'বড় শক্তি'র ধারণা
শাওনের এই অদম্য মনোভাবের মূলে রয়েছে তার শক্তিশালী পারিবারিক রাজনৈতিক পটভূমি। তিনি শুধু হুমায়ুন আহমেদের স্ত্রী নন, তার বাবা প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলী এবং মা তহুরা আলী (সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য) দুজনেই ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। সম্প্রতি তার বাবার বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও তাকে দমাতে পারেনি, বরং তিনি যেন আরও শক্তিশালী বার্তা নিয়ে ফিরে এসেছেন।
গ্রেপ্তার ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনাগুলো এই প্রভাবশালী নারীকে সামান্যতম বিচলিত করতে পারেনি। বরং এটি প্রমাণ করে, তিনি এমন এক দুর্ভেদ্য ক্ষমতার বৃত্তে অবস্থান করছেন যেখানে আইন বা জনরোষ তাকে স্পর্শ করতে পারছে না। মেহের আফরোজ শাওন যেন এখন দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে এক অচেনা শক্তির প্রতীক, যিনি যা ইচ্ছে বলে যাবেন, আর কেউ তাকে কিছু বলবে না।
এই রহস্যময় ক্ষমতার উৎস কী? নেটিজেন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। শাওন কি কোনো অদৃশ্য এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন, নাকি তিনি নিজেই এখন নিয়ম-নীতির ঊর্ধ্বে থাকা এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তিত্ব? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো নিকট ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে না, তবে তার দাপট যে আপাতত অক্ষুণ্ণ, তা স্পষ্ট।
রার/সা.এ
সর্বশেষ খবর
এক্সক্লুসিভ এর সর্বশেষ খবর