
ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার সীমান্তবর্তী রাউতনগর খালের পুনঃখননের ফলে এলাকার কৃষিতে নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আট কিলোমিটার দীর্ঘ খালটি পুনরুজ্জীবিত হওয়ায় আশপাশের ২৫ হাজার একর জমির চিত্র বদলে গেছে; একফসলি জমিগুলো এখন তিন ফসলের সম্ভাবনায় মুখর। খাল খননের ফলে শুধু কৃষকের ভাগ্যই ফেরেনি, সরকারি প্রায় ৩০ একর জমিও দখলমুক্ত হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে পলি জমে রাউতনগর খালের পানিপ্রবাহ বন্ধ ছিল। শ্রীপুর মৌজা থেকে শুরু হয়ে কেউটান বর্ডার ব্রিজ পর্যন্ত বিস্তৃত খালটি একসময় জীববৈচিত্র্যের প্রাণকেন্দ্র ছিল। পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রতি বর্ষায় আশপাশের হাজার হাজার একর জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতো। অধিকাংশ জমিতে বোরো ধান ছাড়া অন্য কোনো ফসল ফলানো সম্ভব ছিল না। পরিবারের জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষককে বছরের প্রায় ছয় মাস কাজবিহীন থাকতে হতো।
স্থানীয় বাসিন্দা তোতা মিয়া সেই কঠিন দিনগুলোর কথা স্মরণ করে বলেন, “আগে বর্ষায় জমিতে পুকুরের মতো পানি থাকতো, ফসল পচে নষ্ট হতো। আর শীতকালে খাল পুরোপুরি শুকিয়ে যেতো, সেচের জন্য সামান্য পানিও মিলতো না। আমাদের বাপ-দাদারাও এই জমিতে একের বেশি ফসল তোলার কথা ভাবতে পারেননি। বর্তমানে আমরা এখানে তিন ফসল বা তার থেকে বেশি করতে পারব।”
সম্প্রতি পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উদ্যোগে খাল পুনঃখননের পর জমি থেকে দ্রুত পানি নেমে যাওয়ায় এলাকার কৃষক হাতে পাচ্ছেন বছরের তিনটি মৌসুমকে কাজে লাগানোর সুযোগ। শুধু ধান নয়, এখন আলু, গম, ভুট্টা, তেলবীজ এবং নানা ধরনের উচ্চমূল্যের সবজি চাষ করে কৃষকের আয় বাড়বে বহুগুণ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, রাউতনগর খালের পুনঃখনন এলাকার প্রায় ২৫ হাজার একর জমিতে এখন তিন মৌসুমে ফসল ফলবে। এতে প্রতিবছর এই অঞ্চল থেকে শত শত কোটি টাকার কৃষিপণ্য উৎপাদিত হবে। এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কেবল কৃষকের জীবনমান পাল্টাবে না, এটি গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
খাল খননের ফলে একদিকে যেমন জমির দ্রুত পানি নিষ্কাশন নিশ্চিত হচ্ছে, তেমনি শুষ্ক মৌসুমে খাল থেকে সহজেই সেচ নেওয়া যাবে। এতে জমি উর্বর হচ্ছে এবং পানির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ দখলে থাকা সরকারি প্রায় ৩০ একর জমি উদ্ধার হয়েছে।
কৃষক শামসুল হক (৪২) খালপাড়ে গড়ে তুলেছেন সবজির বাগান। তিনি বলেন, “খাল খননের পর শুধু ধান নয়, খালের দুই পারে আমরা এখন বাঁধাকপি, বেগুন, টমেটোসহ নানা ধরনের উচ্চমূল্যের সবজি চাষ করছি। বাজারে সবজি বিক্রি করে ভালো আয় হবে। আগে কাজের খোঁজে ঢাকা বা চট্টগ্রামে যেতে হতো, এখন নিজের জমিতেই বারো মাস কাজ।”
আরেক কৃষক রফিকুল ইসলাম (৪৬) বলেন, “আমার বাবা-দাদারা এক ফসলের বেশি কখনও ভাবতে পারেননি। অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। কিন্তু এখন একই জমি থেকে তিনটা ফসল তুলতে পারব। আগের চেয়ে আয় বাড়বে প্রায় তিনগুণ। ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পড়ার খরচ নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না।”
নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম জাকারিয়া বলেন, উদ্ধার হওয়া জমি এখন সরকারি ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগানো হবে। প্রকল্পটি প্রমাণ করে যে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব এবং এর সুফল বহুমাত্রিক। তিনি বলেন, “আমরা খালটি স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের জন্য নতুন পরিকল্পনা নেব, যাতে কৃষকরা বহু বছর ধরে পানির স্বাভাবিক প্রবাহের সুবিধা পান এবং জমির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা সর্বোচ্চ বৃদ্ধি পায়। রাউতনগর খাল এখন শুধু একটি জলপথ নয়, এটি এই অঞ্চলের মানুষের নতুন স্বপ্ন, সচ্ছলতা ও সম্ভাবনার প্রতীক।”
ঠাকুরগাঁও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) আলমগীর কবির বলেন, “এই খাল খনন এটি এই অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিকে একটি মজবুত ভিত্তি দিল। আগে যেখানে এক মৌসুমে সামান্য ধান হতো, এখন সেই জমিতে ধান, আলু, গম, ভুট্টা, শাকসবজি মিলিয়ে একাধিক ফসল হচ্ছে। কৃষকের জীবনমান পাল্টে গেছে। কৃষকরা এখন আধুনিক চাষাবাদে আগ্রহী হচ্ছেন, নতুন নতুন ফসল ফলাচ্ছেন।”
কুশল/সাএ
সর্বশেষ খবর