
নগরের কদমতলী রেলওয়ে বস্তিতে বসবাস করেন প্রতিবন্ধী মো. নাজিম উদ্দিন। হুইলচেয়ারে চলাফেরা করা এ মানুষটি হাত পেতে যা আয় করেন, তা দিয়ে স্ত্রী ও এক মেয়ের সংসার চলে না। মাসে একবারও তাদের মাংস খাওয়া হয় না।
তবে এখন প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনি হাজির হন এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের পাশের ফুটপাতে। সেখানে একবেলা মাংস-ভাত আর ডাল খেয়ে পরিতৃপ্ত মনে ফিরে যান বাড়িতে। কারণ, দিনে তিনি করেন একটি ভালো কাজ আর সেই কাজের বিনিময়েই মিলছে আহার।
তার মতোই বিধবা মরিয়ম বেগম প্রতিদিন সন্ধ্যায় ১০ বছরের ছেলে আদিলকে নিয়ে আসেন স্টেডিয়ামপাড়ায়। মানুষের বাসায় কাজ করে সংসার চালান মরিয়ম, কিন্তু সব ব্যয় মেটাতে পারেন না। তাই তিনিও এই ‘ভালো কাজের হোটেলের’ নিয়মিত অতিথি।
প্রতিদিন মহানগরের দুটি স্থানে, দুপুরে মহসিন কলেজের সামনে এবং সন্ধ্যায় এমএ আজিজ স্টেডিয়ামপাড়ায়, রিকশাচালক, ভিক্ষুক, দিনমজুর ও পথচারীদের জন্য চলছে একবেলা খাবারের ব্যতিক্রমী আয়োজন। তবে শর্ত একটাই– দিনে করতে হবে একটি ভালো কাজ।
প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টায় মিনি ট্রাক নিয়ে হাজির হন স্বেচ্ছাসেবক দল। তাদের পরনে থাকে হলুদ টি-শার্ট, মুখে হাসি আর হাতে ভাত-মাংসের প্যাকেট। রাত ৯টা পর্যন্ত চলে খাবার বিতরণ। দুপুরে একইভাবে চকবাজার এলাকায় চলে অনুরূপ আয়োজন।
স্বেচ্ছাসেবক মো. নাজমুল বলেন, ‘প্রতিদিন দুই স্থানে গড়ে ৪৫০ জন অতিথিকে ভালো কাজের বিনিময়ে বিনামূল্যে খাবার দিই আমরা। কাউকে কোনো টাকা-পয়সা দিতে হয় না– শুধু দিনে একটি ভালো কাজ করলেই চলে।’
তিনি জানান, প্রতি শুক্রবার মুরগির মাংস-ভাত, তিন দিন ডিম-সবজি-ডাল এবং তিন দিন খিচুড়ি-ডিম পরিবেশন করা হয়। প্রতিদিন খিচুড়ির জন্য ব্যয় হয় প্রায় ২৩ হাজার টাকা, ডিম-সবজিতে ৪০ হাজার।
‘ভালো কাজের হোটেল’-এর সমন্বয়ক মো. মোরশেদ বলেন, “আমাদের সংগঠন ‘ইয়ুথ ফর বাংলাদেশ’-এর প্রায় ২ হাজার সদস্য আছেন সারাদেশে। শুধু চট্টগ্রামেই আছি ৩৫০ জন। সদস্যরা মাসে ৩০০ টাকা করে চাঁদা দেন। সেই চাঁদা ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনুদানেই চলছে এই আয়োজন।”
খাবার বিতরণের আগে অতিথিদের নাম ও দিনের ভালো কাজের বিবরণ লিখে রাখা হয়। একজন ভিক্ষুক, রিকশাচালক বা ভবঘুরে– যেই আসুক না কেন, দিনের সৎ কাজের প্রমাণ দিলেই হাতে তুলে দেওয়া হয় ভাত-মাংস-ডালের প্লেট।
অতিথি রিকশাচালক মজনু মিয়া বলেন, ‘প্রথম দিন ভালো কাজ না করায় খাবার পাইনি। পরদিন দুইটা ভালো কাজ করে খেতে এসেছি। এখন প্রায়ই এখানে এসে খাই, আর ভালো কাজ করি।’
পাহাড়তলীর সরাইপাড়ায় রান্না হয় প্রতিদিনের এই বিশাল আয়োজনের খাবার। পরে তা ট্রাকে করে শহরের নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেওয়া হয়। স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রত্যেকেই বিশ্বাস করেন– এই কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষ শুধু একবেলা আহারই পাচ্ছে না, বরং জেগে উঠছে সততা, সহানুভূতি ও মানবতার চেতনা।
চট্টগ্রামের ফুটপাতজুড়ে এই উদ্যোগ এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। মানবিক একদল তরুণের এই ‘ভালো কাজের হোটেল’ ছুঁয়ে যাচ্ছে ক্ষুধার্ত মুখগুলো, আর ছড়িয়ে দিচ্ছে আশার আলো– ভালো কাজের বিনিময়ে একবেলা তৃপ্তির আহার।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর