ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলায় সোলার প্যানেল স্থাপনার নামে কোটি টাকা লুটপাটের সত্যতা পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বুধবার দুদকের ময়মনসিংহ সমন্বিত জেলা কার্যালয় থেকে একটি তদন্ত দল এই অভিযান পরিচালনা করে।
অভিযানে নেতৃত্ব দেন সহকারী পরিচালক ও টিম লিডার রাজু মো. সারওয়ার হোসেন। এই অভিযানে আরও অংশ নেন ময়মনসিংহ কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক মো. রেজওয়ান আহমেদ ও ইব্রাহিম খলিল। দুদক জানায়, গৌরীপুর উপজেলার প্রায় ৩০০ সোলার প্যানেল প্রকল্পের বাস্তবায়ন ঘিরে বিভিন্ন এলাকায় অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রকটতা দেখা গেছে। অধিকাংশ সোলার প্যানেল নষ্ট হয়ে গেছে, অনেক ক্ষেত্রে সঠিকভাবে স্থাপনই করা হয়নি। ফলে প্রকৃত সুবিধাভোগী সাধারণ জনগণ এসব প্রকল্প থেকে উপকার না পেয়ে বরং বঞ্চিত হয়েছেন।
দুদকের সহকারী পরিচালক রাজু মো. সারওয়ার হোসেন বলেন, “যতগুলো প্রকল্প পরিদর্শন করেছি, প্রত্যেকটিতেই অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে। সোলার প্যানেল স্থাপনায় ন্যূনতম মান বজায় রাখা হয়নি। একটি ভবনের ছাদে ১০টি করে প্যানেল বসানো হয়েছে, অথচ এলজিইডি অফিসে খোঁজ করেও ওইসব প্যানেলের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।”
গৌরীপুর কলতাপাড়া সড়কের দুটি প্রকল্পে ৪০টি সোলার প্যানেলের মধ্যে পাওয়া গেছে মাত্র ৩২টি। ইউএনও বাসভবন, উপজেলা পরিষদ এবং বিভিন্ন কর্মকর্তার বাসায়ও এসব প্যানেল বসানো হয়েছে। বিত্তবান, ক্ষমতাবান ও রাজনৈতিক নেতাদের বাসায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এসব প্যানেল, যেখানে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যুৎবিহীন বা জনসমাগমপূর্ণ এলাকাকে আলোকিত করা।
অভিযান চলাকালে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসে কাউকে পাওয়া যায়নি। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও অফিসার বা অফিস সহকারী কেউই আসেননি। দুদক জানিয়েছে, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হবে।
সূত্র জানায়, প্রকল্পের পেছনে তৎকালীন স্থানীয় এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন আহমেদ ও তার পুত্র, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক তানজির আহমেদ রাজিবের প্রত্যক্ষ মদদ ছিল। কেবল নামমাত্র কাজ করেই ২৯০টি প্রকল্প থেকে প্রায় ৩ কোটি ৯০ লাখ ২৪ হাজার ৫১৬ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ। প্রকল্পে ব্যবহৃত সামগ্রী ছিল নিম্নমানের এবং অধিকাংশ প্যানেল কয়েক মাসের মধ্যেই বিকল হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, মইলাকান্দা ইউনিয়নের গোবিন্দপুর বাজারে বসানো সবগুলো সোলার প্যানেল ৫-৬ মাসের মধ্যে অকেজো হয়ে পড়ে। শ্যামগঞ্জ সড়ক, ডৌহাখলা বাজার ও কলতাপাড়া সড়কে বসানো ১১টি স্ট্রিটলাইটও দীর্ঘদিন ধরে অচল অবস্থায় রয়েছে।
২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে কাবিখা ও টিআর প্রকল্পের অধীনে ২৯০টি প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। কেবলমাত্র ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম ধাপে ৫টি কাবিখা প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৫৬ লাখ ৬৪ হাজার ৪০০ টাকা, দ্বিতীয় ধাপে আরও ১৫টি প্রকল্পে সমপরিমাণ অর্থ বরাদ্দ হয়। টিআর প্রকল্পে একইভাবে কয়েক কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়, যার বড় অংশই লুটপাট হয়েছে বলে অভিযোগ।
২০১৭ সালের একটি অফিস আদেশে সোলার প্যানেলের মূল্য ধার্য করা হয় বাজার দরের চেয়ে ৪-১০ গুণ বেশি। যেমন, সরকারি দরে ২৫০ডব্লিওপি প্যানেলের মূল্য দেখানো হয় প্রায় ৪৯ হাজার টাকা, অথচ রহিম আফরোজ কোম্পানির একই ক্ষমতার প্যানেল বাজারে পাওয়া যায় মাত্র ৮ হাজার ৯২৫ টাকায়। এতে বুঝা যায়, প্রকল্পে কৃত্রিমভাবে উচ্চমূল্য নির্ধারণ করে দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে। ২০১৭ সালের মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় স্পষ্ট বলা ছিল— বিদ্যুৎবিহীন এলাকা, স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ, এতিমখানা, হাট-বাজার ও জনসমাগমপূর্ণ স্থানে সোলার প্যানেল স্থাপন করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে বরাদ্দ পেয়েছেন জনপ্রতিনিধি, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও তাদের পরিবার। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যকেই ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর